হাসান সোহেল : বিনিয়োগ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারি, বেসরকারি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) ও বিদেশী - এই চার ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন নিয়ে কাজ করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা লক্ষ্য। ইতোমধ্যে ৫৯টি অঞ্চলের প্রাথমিক অনুমোদনও মিলেছে। আর অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে প্রথমবারের মতো ১০টির উন্নয়ন কর্মকা-ের উদ্বোধন করা হচ্ছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকা-ের উদ্বোধন করবেন। ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৬টি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং ৪টি সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। যৌথ অঞ্চলগুলোতে সরকার জমি প্রদান করেছে, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেছেন। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যাবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বছরে অতিরিক্ত আরও ৪ হাজার কোটি ডলার রফতানি আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি গতি পাবে, তেমনি বেকার সমস্যা থেকেও মুক্ত হবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বেজা পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে তার আন্তরিকতা থাকায় নির্ধারিত সময়ের আগেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা। যদিও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় হিসাবে বিশেষজ্ঞরা দুর্বল অবকাঠামো এবং জমি অধিগ্রহণকে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠায় প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে জ্বালানি সংকট। তবে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। একই সঙ্গে সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, এত দিন অর্থনৈতিক অঞ্চল ছিল স্বপ্ন। এবার তা বাস্তবে রূপ নেবে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরপরই শুরু হবে অর্থনৈতিক অঞ্চলে আসল কর্মযজ্ঞ। তখন শুরু হবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও সড়ক নির্মাণের কাজ। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, প্লট তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হবে। পবন চৌধুরী বলেন, অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে প্রথমবারের মতো ১০টি অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকা-ের উদ্বোধন করা হবে। এদের মধ্যে ৬টি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং ৪টি সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। যৌথ জোনগুলোতে সরকার জমি প্রদান করেছে, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেছে। তিনি বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারের লক্ষ্য ১০০টি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা। ইতোমধ্যে ৫৯টির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোর বিষয়ে কাজ চলছে। বিনিয়োগ আকর্ষণে সব ধরনের প্রচেষ্টাও চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বেজা নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, অর্থনৈতিক এলাকাগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি গতি পাবে, তেমনি বেকার সমস্যা থেকেও মুক্ত হবে দেশ।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, দেশব্যাপী অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগে আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত বোধ করছি। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দেওয়া সম্ভব হবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে রপ্তানি আয় হবে চার হাজার কোটি ডলার। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এক কোটি মানুষের। কথিত আছে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু মনে করতেন, পরিকল্পিত শিল্পায়নই হতে পারে ভারতের উন্নয়নের একমাত্র পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, গ্রামীণ অর্থনীতি কিংবা কুটির শিল্প নয়; বরং শিল্পায়নের মাধ্যমেই ‘নতুন ভারত’ তৈরি করা সম্ভব। যদিও শিল্পায়নের দিকে এগোতে গিয়ে নিজ দল কংগ্রেস ও সুধী সমাজের তীব্র বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে, তবু নেহরু তার বিশ্বাসের পথেই হেঁটেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত এখন বিশ্ব অর্থনীতির এক নতুন পরাশক্তি।
অপরদিকে স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেলেও পরিকল্পিত শিল্পায়নের পথে হাঁটতে পারেনি বাংলাদেশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সাভার আর গাজীপুরে অপরিকল্পিতভাবে কিছু শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলেও মূলত কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভর করেই বাংলাদেশ চার দশক পার করে ফেলেছে। কিন্তু সব নাগরিকের জন্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি দেশের কোনো সরকারই। ফলে শহর থেকে শুরু করে জেলা এমনকি ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত ধনী-দরিদ্র বৈষম্য প্রকট হয়েছে।
তবে আশার কথা হলো, কৃষি আর গ্রামীণ অর্থনীতির পুরনো বৃত্ত ভেঙে ভারতের মতো পরিকল্পিত শিল্পায়নের পথেই হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর পরই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন বৈষম্য দূর করতে দেশের সব জেলায় একটি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবেন। এ জন্য গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সুষম উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং সবার জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে ৫৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতার চার দশক পর প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই। তাতে ব্যাপক সাড়াও মিলছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে চীন, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের সার্বিক দিক দেখভালের দায়িত্বে থাকা বেজার কর্মকর্তারা জানান, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সরকারি মালিকানাতেই স্থাপনের ইচ্ছে সরকারের। বেসরকারিগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে স্থানীয়, প্রবাসী বাংলাদেশী বা বিদেশী ব্যক্তি, সংস্থা ও ব্যবসায়ী দলকে। পিপিপিগুলো হবে দেশী বা বিদেশী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ ছাড়া বেসরকারি, পিপিপি বা সরকারি উদ্যোগে গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন।
বেজার কর্মকর্তারা জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য যে আইন করা হয়েছে, তাতে যে কোনো দেশ সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে পারবে। ব্যবসা করতে পারবে বিদেশী যে কোনো প্রতিষ্ঠানও। এ ছাড়া দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সবার জন্য অবারিত সুযোগ রাখার কারণে প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় কম্পানি যোগাযোগ করছে। প্রণোদনার প্যাকেজ, আইন-কানুনসহ বিনিয়োগের খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে অনেকে বেজা কার্যালয়ে আসছে। ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও। এক থেকে দুই বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সবার সামনে দৃশ্যমান হবে বলে আশা করছেন বেজার কর্মকর্তারা।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য দেশে সুষম উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি। যেসব জেলা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে, সেসব জেলায় উন্নয়ন ঘটানো হবে শিল্পায়নের মাধ্যমে। পবন চৌধুরী বলেন, কোনো জেলা আর পিছিয়ে থাকবে না। সব জেলায়ই একটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানান তিনি। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে শুধু দেশীয় বিনিয়োগকারী নয়, বিদেশী বিনিয়োগকারী টানতে নানা ধরনের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। কর অবকাশ সুবিধা, আয়ের ওপর কর মওকুফ, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রণোদনা ঘোষণার পর তার সুফলও পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে তাইওয়ানের স্টেলা গ্রুপ, চীন, জাপান, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানান তিনি।
বেজা সূত্রে জানা যায়, ভারতের বিনিয়োগ আকর্ষণে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে একটি বাগেরহাটের মংলায় ২০৫ একর জমির ওপর। অন্যটি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৫০৭ একর জমির ওপর। দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। নীতিনির্ধারকরা আশা করছেন, ভারতের রিলায়েন্স, আদানি গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে। অন্যদিকে চীনা উদ্যোক্তাদের জন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৭৪ একর জমির ওপর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। জাপানের উদ্যোক্তাদের জন্য গাজীপুরের শ্রীপুরে এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি রাখা হয়েছে। বেসরকারিভাবে দেশীয় অনেক শিল্প গ্রুপ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই মধ্যে ছয়টি সফল ব্যবসায়ী গ্রুপকে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় প্রাক-যোগ্যতা লাইসেন্স দিয়েছে বেজা। যে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো এ কে খান গ্রুপ, আবদুল মোনেম লিমিটেড, মেঘনা গ্রুপের দুটি, বে গ্রুপ এবং আমান গ্রুপ। আরো কয়েকটি কম্পানি লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বেজার কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ যে অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন কর্মকা-ের উদ্বোধন করবেন এর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো-চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাগেরহাটের মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং টেকনাফের সাবরাং পর্যটন অঞ্চল। আর বেসরকারিভাবে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো নরসিংদীর পলাশে এ কে খান গ্রুপ, মুন্সীগঞ্জে আবদুল মোনেম লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় মেঘনা গ্রুপের দুটি, গাজীপুরে বে গ্রুপ এবং নারায়ণগঞ্জে আমান গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরই ওই সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূল কাজ শুরু হবে।
বেজা সূত্রে জানা গেছে, সরকারি উদ্যোগে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে চট্রগ্রামের মিরসরাইয়ে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে ইছাখালী চরের ৭ হাজার ৭১৬ একর জমিতে। এতে এক হাজার ২২২টি কারখানার প্লট তৈরি করা হবে। এছাড়া এরই মধ্যে চরে জেগে ওঠা ১৫ হাজার একর জমির মধ্যে প্রথম অবস্থায় চারটি মৌজায় ৬৩৯০ দশমিক ৯৬৭০ একর জায়গারও উন্নয়ন কাজ চলছে। এর মধ্যে পীরের চর এলাকায় আছে ১৩৯০ দশমিক ৪৩১৬ একর, সাধুর চর এলাকায় আছে ১৬৬৪ দশমিক ১০৩৯ একর, শিল্প চর এলাকায় ১৮৫২ দশমিক ৫৩৮৫ একর ও মোশাররফ চর এলাকায় ১৫০৪ দশমিক ২৯৩০ একর। জাপানের এক সমীক্ষায় বলা হয়, এ অঞ্চল পোশাক কারখানা, টেক্সটাইল, অটোমোবাইল, অটোমোবাইল পার্টস তৈরি এবং শিপবিল্ডিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। এটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রায় ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য সরকারি- বেসরকারি মোট ৩৫৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এ অঞ্চল সিরামিকস, টেক্সটাইল, গ্লাস তৈরি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য উপযোগী। মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল মংলা বন্দর থেকে কাছে হওয়ায় সেখানে বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা বেশ আগ্রহী। মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাক কারখানা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা এবং শিপইয়ার্ডের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হতে পারে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাংয়ে একটি পর্যটন অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। কক্সবাজারের সাবরাং ট্যুরিজমের জমির পরিমাণ ১০২৭ একর। পক্ষান্তরে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। এরই মধ্যে ভূমি উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলটি দুই দফায় ৩২৫ একর জমির ওপর গড়ে উঠবে। প্রথম দফায় ২১৬ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ করবে। এরই মধ্যে মাটি ভরাট, সীমানা প্রাচীরের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সম্পূর্ণ অবকাঠামো গড়ে উঠলে এতে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সূত্র আরও জানায়, মেঘনা গ্রুপ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে। এর মধ্যে ২৪৫ একর জমির উন্নয়ন কাজ প্রায় শেষ করা হয়েছে। আর মেঘনা শিল্প অঞ্চল হবে পৃথকভাবে ৮০ একর জমির ওপর। আমান অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে মেঘনা নদীর পাশে ১৫০ একর জমির ওপর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে চার কিলোমিটার পাকা সড়ক যোগাযোগ রয়েছে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের। মেঘনা নদীর মাধ্যমে নৌপথেও যোগাযোগের সুবিধা রয়েছে। নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে সিমেন্ট কারখানা, প্যাকেজিং, শিপইয়ার্ড, ফুড ও বেভারেজ, ইলেক্ট্রনিকস, স্টিল ও আইটি শিল্প স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। বে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গাজীপুরের কোনাবাড়িতে ৬৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা হবে।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ইকোনোমিক জোন অথরিটি আয়োজিত (বেজা) বিনিয়োগ আকর্ষণ বিষয়ক এক রোডশো অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় হিসাবে দুর্বল অবকাঠামো এবং জমি অধিগ্রহণকে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবন চৌধুরী বলেন, জমি অধিগ্রহণই অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিলো। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছি। ফেনি ও মিরের সরাই চরাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার একর জমি পাওয়া গেছে। সেখানেই অন্তত ৪০-৫০টির মতো অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। গ্যাস সংকট প্রসঙ্গে পবন চৌধুরী বলেন, সরকার তিনটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থনৈতিক জোনগুলোর সঙ্গে এই টার্মিনালগুলোর সংযোগ থাকবে। তবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসাবে তিনি উল্লেখ করে বলেন, এই দিকে সরকারের আরও মনোযোগ দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, অর্থনৈতিক জোনগুলোতে ব-মুখী বিনিয়োগের ব্যবস্থা থাকবে। এগুলো হবে বিনিয়োগ ভিত্তিক অর্থনৈতিক জোন। প্রতিটি জোনে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্লট সংরক্ষিত থাকবে। একটি জোন হবে তৈরি পোশাকের জন্য। অর্থ সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো বিনিয়োগের জন্য অনুকূল অবস্থায় আছে। এতো ভাল সূচকের মধ্যেও আশানুরুপ বিনিয়োগ দেশে হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার চাচ্ছে দেশের মানুষের জীবন মান উন্নত করতে। এজন্য মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। আর মাথাপিছু আয় বাড়াতে হলে আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ইউটিলিটি সুবিধা বাড়াতে হবে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে বিশাল আভ্যন্তরীন বাজার রয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বাজারও ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশের রয়েছে সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বাজার। এসব বাজারে বাংলাদেশী পণ্য শূন্য শুল্কে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার কারণে উন্নত দেশগুলোতেও বাংলাদেশী পণ্যের শূন্য শুল্ক সুবিধায় প্রবেশাধিকার রয়েছে। এসকল সুবিধা বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিরাট সুযোগ তৈরি করেছে। পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে মানুষ আশাবাদী। এ আশাবাদের কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। একশ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা এই চেষ্টারই একটি উদাহরণ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে। কৃষি ভিত্তিক দেশ হিসাবে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষি সহায়ক বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া পুজিঘন এবং শ্রমঘন শিল্পেও বাংলাদেশ সফল হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিনিয়োগ বাস্তবায়নে গতির সঞ্চার করবে। অবশ্য অবদুল মোনেম ইকোনোমিক জোনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মইনুদ্দিন মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যে আগ্রহ তাতে ১০ বছরেই দেশে ১০০ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের আগস্টে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন পাস হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পরিচালনা পরিষদের বৈঠক। অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ শেষ করতে ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্প (পর্যায়-১)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও হাতে নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেজা পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান। ইতোমধ্যেই বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নীতি ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন ২০১০ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল বিধিমালা ২০১৪ সংশোধন করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন