ল. কর্নেল আকম জাহিদ হোসেন (অব:)
\ শেষ কিস্তি \
শয়তান তো মদ-জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রæতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহ স্মরনে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না। (সূরা মায়িদা : ৯০-৯১)। এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) একজনকে দিয়ে মদিনা এলাকার আনাচে-কানাচে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলেন। হযরত আনাস (রা.) বললেন, ওই সময়ে তিনি হযরত আবু তালহা (রা.)’র ঘরে লোকেদের মদ পরিবেশন করছিলেন। হযরত আবু তালহা (রা.)-কে জানালেন যে, মদ হারাম করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে।
এ সংবাদ জানার পর হযরত আবু তালহা (রা.) হযরত আনাস (রা.)-কে বললেন, এগুলো সব ঢেলে দাও। হযরত আনাস (রা.) বললেন, যেদিন এ সংবাদ ঘোষণা দেয়া হল সেদিন গোটা মদিনা নগরীতে রাস্তায় রাস্তায় মদের ¯্রােত বইতে লাগল। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মদ পান করা হারাম। এ হারাম কথাটি একবারে নাযিল না হয়ে বরং পর্যায়ক্রমে নাযিল হয়েছে। এ সম্পর্কে আলেমগণ বিশ্লেষণ করে বলেন যে, সে সময়ে মানুষ মদ পানে খুব বেশি আসক্ত ছিল। একবারে হঠাৎ করে মদ পান নিষেধ আদেশ নাযিল হলে এ আদেশ পালন করা মদীনাবাসীদের পক্ষে কষ্ট হতো। পূর্বে বর্ণিত (সূরা মায়েদা : ৯০-৯১) আয়াতের মাধ্যমে মদ পান করাকে ঘৃণ্য কাজ বলা হয়েছে। ঘৃণ্য কাজ সদাসর্বদাই পরিতাজ্য। আয়াতে এমনিভাবে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। ফলে, এতেও মদ পান করা বিষয়টি হারাম বলে প্রতীয়মান হয়। একইভাবে জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ইত্যাদি একত্রিতভাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। সুতরাং এগুলো যেমন হারাম তেমনি মদপান করাও হারাম। যদি মদ পান হালাল হতো তাহলে মহান সৃষ্টিকর্তা একে বর্জন করার আদেশ দিতেন না। মদ পান করা বিষয়টি পবিত্র হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, সে তখন মু’মিন থাকে না এবং মদ্যপয়ী যখন মদ্যপান করে সে তখন মু’মিন থাকে না... (বু: শ: ৬৩০৬) হযরত আনাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত। নবীজি (সা.) মদ পান করার জন্য খুরমা গাছের শাখা ও জুতা দিয়ে প্রহার করেছেন এবং আবু বকর (রা.) চল্লিশ চাবুক মেরেছেন (বু: শ: ৬৩০৭)। হযরত আবু বকর ইবনে আবু শায়বা (র.) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, নবীজি (সা.) বলেছেন, কেউ মাতাল হলে তাকে বেত্রাঘাত কর। সে পুনরায় মাতাল হলে তাকে বেত্রাঘাত কর। সে পুনরায় মাতাল হলে আবারো তাকে বেত্রাঘাত কর। এরপর চতুর্থবার বললেন, সে যদি পুনরায় মাতাল হয় তবে তার গর্দান উড়িয়ে দাও (সুনানু ইবনে মাজাহ : ২৫৭২)। মদ্য পান করা যে কত ঘৃণ্য কাজ এ শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেই তা অতি সহজেই বুঝা যাচ্ছে। নবীজি (সা.) মদ সম্পর্কে কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে বলেছেন, সর্বপ্রকার অপকর্ম এবং অশ্লীলতার জন্মদাতা হচ্ছে শরাব। এটি পান করে মানুষ নিকৃষ্টতর পাপে লিপ্ত হতে পারে। মদ হারাম হওয়ার সংবাদ ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে যার কাছে মদের কলস, মটকা ছিল তা ঘর থেকে বের করে সাথে সাথে ভেঙ্গে ফেলেছেন। অন্যান্য বর্ণনায় আছে এ ঘোষণার সময়ে যার হতে মদের পেয়ালা ছিল এবং তা মাত্র পান করার জন্য ঠোঁটে স্পর্শ করেছিল, সে অবস্থাতেই দূরে নিক্ষেপ করে ফেলে দিয়েছে। সেদিন মদীনা নগরীতে বৃষ্টির ন্যায় মদ প্রবাহিত হচ্ছিল। দীর্ঘদিন যাবত মদীনার মাটিতে মদের গন্ধ ও মাটির রং উপরে ফুটে উঠেছিল। মদ পানে কিছু উপকারীতাও রয়েছে আবার এ পানে অপকারীতাও আছে। এর উপকারিতার তূলনায় অপকারিতাই অনেক বেশি। মদ পানে হয়ত আনন্দ, উৎসাহ ও তৃপ্তি পাওয়া যায়। কাজে-কর্ম হয়ত বা সাময়িকভাবে আমেজ, সতেজতা, উদ্দীপনা ও শরীরে লাবণ্যও সৃষ্টি হয়। তবে এ মামুলী উপকারিতার চেয়ে এর অপকারিতা ও ক্ষতির দিকটা অর্থাৎ কুফলটাই অনেক বেশি। মদের প্রতিক্রিয়ার ক্রমে ক্রমে মানুষের পেটে খাবারের হজম শক্তি লোপ পেতে থাকে। খাদ্যস্পৃহা কমে যায়। চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। ¯œায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। শরীরকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করতে থাকে। মুখের দাঁত নষ্ট হতে থাকে। গলার স্বর নষ্ট হয়ে যায়। একজন জার্মান ডাক্তার বলেছেনÑ যারা মদ্য পান করে তারা চল্লিশ বছর বয়সেই ষাট বছরের বৃদ্ধার মত অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। ষাট বছরের বৃদ্ধের যেমন শরীরের গঠন থাকে তার শরীরের গঠন তার চেয়ে আরও খারাপ হয়ে পড়ে। লিভার এবং কিডনিতে আঘাত করে এসব নষ্ট করে ফেলে। য²া রোগটি ও মদ্য পানের এক বিশেষ পরিণতি। অতিরিক্ত মদ্য পান মানুষের মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনা অনেক আছে। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির উপর এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। শরাব পানে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মাতাল ব্যক্তি মাতাল অবস্থায় নিজ জ্ঞান, বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় তার পক্ষে যে কোন ভারসাম্যহীন কাজ এমন কি বিভিন্ন অপকর্ম অপকীর্তি করা মোটেও অসম্ভব ব্যাপার নয়। মাতাল অবস্থায় তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। শরীরের শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। এমনকি মাতাল অবস্থায় আবল-তাবল ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে থাকে। অতিরিক্ত মধ্য পানে বমি করে, এমনকি পায়খানা করে নিজের কাপড়-চোপড় নষ্ট করে ফেলে। মদ্য পানে আসক্ত হয়ে গেলে মদেও পেছনে অর্থ সম্পদ বেহিসাবে ব্যয় করতে থাকে। সহায় সম্পত্তি, স্ত্রীর গয়না, ঘরের সঞ্চয়, মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সবই মদেও পেছনে বিলিয়ে দিয়ে শেষ করে, দেউলিয়া হয়ে যায়। মদ্য পান এক প্রকার সংক্রামক। দেখা যায়; পরিবারের উত্তরসূরীদের নিকটও এটা সংক্রামিত হয়; তাদের একই অভ্যাসে পরিণত হয়। মদ ও মাদকদ্রব্যের আরও আপকারিতা একেক করে বিস্তারিতভাবে এখানে আলোচনা করা হলো। মদ্যপায়ী ব্যক্তি যখন মদ পান করে তখন তার থেকে ঈমানের নূর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ব্যভিচারী ও মদ পান করার সময় ঈমানদার অবস্থায় থাকে না। এমনিভাবে চুরি করার সময় ঈমানদার অবস্থায় থাকে না। (বুখারী)। মদ্যপানকারীর ওপর আল্লাহ লা’নত বর্ষণ করেন। মদ্য পানের কারণে দুশ্চিন্তা, রিযকের সংকীর্ণতা, চেহারা বিকৃত এবং ভূমিকম্প ও ভূমি ধসে যাওয়া ইত্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে। মদ পানের কারণে মদ্যপায়ী ব্যক্তির সর্বপ্রকার গুনাহ লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা এ হচ্ছে সমস্ত গুনাহের উৎস। মদ্যপায়ী ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন মহিলাদের জননেন্দ্রিয় থেকে নির্গত দুর্গন্ধময় পুঁজ পান করানো হবে। মূর্তি ও প্রতীমা পূজারীর মত মদখোর ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান করা হবে। নবীজি (সা:) বলেনÑ মদখোর ব্যক্তি প্রতিমা পূজারীর মত এবং মদখোর ব্যক্তি লাত ও উযযার পূজারীর মত (কানযুল উম্মাল, ৫ম খÐ)। এই তুলনা হারাম হওয়ার দিক থেকে হতে পারে। এমনি ভাবে শাস্তির দিক থেকেও হতে পারে। চরম পিপাসিত অবস্থায় মদখোর ব্যক্তি হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে। নবীজি (সা.) বলেন, মদপানকারী ব্যক্তি কিয়মতের দিন পিপাসার্ত অবস্থায় হাসরের ময়দানে উপস্থিত হবে। (কানযুল উম্মাল, ৫ম খÐ)। মদখোর ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও তার নসীব হবে না। নবীজি (সা.) বলেনÑ তিন ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাত হারাম করেছেন। ক. মাদকাসক্ত ব্যক্তি। খ. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, গ. আর দায়ুস যে তার পরিবারে যিনা জাতীয় পাপকর্ম জারি রাখে। (মিশকাত)। মদপানকারী ব্যক্তি লাঞ্ছনা ও হেয়তার উপযুক্ত। নবীজি (সা:) বলেনÑ তোমরা মদখোর ব্যক্তিকে সালাম করবে না। মদ পানের ফলে মানুষ যত পাগল হয় এবং পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয় ততটা আর কিছুতে হয় না। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি মাতাল হয়ে আপনজনকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। এমন ঘটনা অনেক রয়েছে। মদ্যপানে যে রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয় তা বংশ পরম্পরায় বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। (আল ফিকাহ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ, ৫ম খÐ)। ইদানীং আমাদের সমাজে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের মাঝে মাদকদ্রব্য বা নেশা সেবন এক আধুনিকতা, আভিজাত্যতা ও বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। তারা আনন্দ উৎসব নামে এসব প্রাণনাশক দ্রব্য সেবন করে নিজেদের, অমূল্য জীবনকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। অথচ এসব কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, আমাদের দেশের সম্পদ ও ভবিষ্যৎ। এ প্রজন্মই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তবে কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের বিপদগামী করার জন্য কোন কুচক্র মহল বা অশুভ চক্র লেগে রয়েছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক সংস্থাসমূকে গভীরভাবে সজাগ ও সচেতন হতে হবে। ইসলামের মূল আদর্শ হতে আধুনিকতার নামে আমরা নতুন এক অভিনব জাহিলিয়াতের যুগে প্রবশে করছি। এ সমাজকে এভাবে প্রবাহিত হতে দেয়া মানে দেশ ও জাতির জন্য এক ভয়াবহ অশনিশঙ্কেত। দেশের প্রশাসন ও আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী আরেকটু তৎপর হলেই সমাজ থেকে এ অভিশাপ দূর করা সম্ভব। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে আমাদেরও তাদের পথ অনুসরণ করে সেভাবে ব্যবস্থা নিয়ে দেশ ও জাতিকে এ অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। দেশে নেশাগ্রস্তদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্নœ ক্লিনিক ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর ও প্রশংসনীয় সেবা। তবে, যেসব অবৈধ পথ দিয়ে এসব পণ্য দেশে প্রবেশ করছে তা অবশ্যই শক্ত ও কঠোর হাতে দমন করে বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনভাবেই শিথিলতা ও নমনীয়তা প্রদর্শন করা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন