শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে শিশু হত্যা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়

প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান-উজ-জামান : থামছেইনা নৃশংস শিশু খুনের ঘটনা। স্কুলে, মাঠে, ঘাটে এমনি নিজ বাসগৃহেও নিরাপদ নয় কোমলমতি শিশুরা। পারিবারিক, সামাজিক বিরোধ, জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং মুক্তিপণের দাবিতে নির্মম বলী হচ্ছে অবুঝ শিশু। একের পর এক শিশু খুন করা হলেও যেন কারও ঘুম ভাঙছে না। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু হত্যার চিত্র বলে দেয় শিশু হত্যা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। শিশু হত্যার এসব ঘটনাকে মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। শিশুদের জন্য আগামী পৃথিবী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি সিলেটের হবিগঞ্জের বাহুবলে মাটি চাপা দেয়া একসঙ্গে তিন চাচাতো ভাইসহ চার শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দেশবাসী শোকাহত এবং আতঙ্কিত। তাদের লাশ উদ্ধারের দৃশ্য স্মৃতিপট থেকে মুছে যেতে না যেতেই সর্বশেষ গত শনিবার কুমিল্লার রসূলপুর শহরে নিজ শয়ন কক্ষেই দুই সহোদর শিশু শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান জয় (৮) ও মেজবাউল হক মনি (৬) হত্যার ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে সকলকে। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া সৎ ভাইয়ের নির্মম বলী আপন দুই ভাই। নিকট অতীতের অনেক খুনের চেয়েও হবিগঞ্জ ও কুমিল্লার এসব লোমহর্ষক ঘটনাগুলো নাগরিকদের শুধু স্তম্ভিত করেনি রীতিমতো অস্থির করে তুলেছে। কখনো কখনো পরম মমতময়ী মা কিংবা বাবার হাতে সন্তান হত্যার ঘটনা ঘটছে। রাজধানীর বেইলি রোডে একটি ভবনের ৬ তলা থেকে সদ্যোজাত সন্তানকে ফেলে দিয়েছেন এক মা! চিকিৎসকদের শত চেষ্টায়ও নবজাতককে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে একহাজার ৬৯ শিশু হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ এবং ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই দেশে ৪৫ জনের বেশি শিশু নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এই পৈশাচিক প্রবণতা এমন হারেই যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বছর শেষে মোট শিশু হত্যার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশিষ্টজনদের ধারণা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গড়ে প্রতিদিন ১টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কজনক শিশু হত্যার চিত্র বলে দেয় শিশু হত্যা আজ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। শিশু নির্যাতনের প্রধান কারণ সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। মানুষের মধ্য থেকে মানবিকতা, সুকুমার বৃত্তি উঠে যাচ্ছে। মানুষ পরিণত হচ্ছে মায়ামমতাহীন এক নিষ্ঠুর প্রাণীতে। বর্বরততা ও নির্মমতার লোমহর্ষক শিশু নির্যাতন দেখে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আদৌ কোন সভ্য দেশে বসবাস করছি? যেখানে মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দেন, আর এখন দেখা যাচ্ছে খোদ মা সন্তানকে নিজ হাতে হত্যা করছেন! প্রতিহিংসা এবং মুক্তিপণের টার্গেট হচ্ছে প্রতিপক্ষের নিষ্পাপ শিশুরা। আজ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা। যেভাবে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকা- যত্রতত্র অহরহ সংঘটিত হচ্ছে তা সভ্য সমাজে নজিরবিহীন। এই পৈশাচিক, ভয়ানক ও বীভৎস হত্যাকা-ের স্থিরচিত্র ধারণ করে তা সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষরূপী হায়েনারা। এসব ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, নৈতিকতার শিক্ষাসহ সর্বস্তরে জনমত গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্কুল পর্যায়েও কাউন্সেলিং চালু করতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, মূল্যবোধের এত বিপর্যয় কেন ঘটছে? শিশুদের সঙ্গে কারও কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত থাকে না। তাদের শুধু ভালোবাসা পাওয়ার কথা। অথচ তারাই নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটার পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে। তার মতে, সুশাসনের অভাব ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াও এমন অপরাধ সংঘটনের একটি বড় কারণ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিশুহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়লেও দেশের রাজনীতিবিদেরা এ নিয়ে তেমন কথা বলেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. জিয়া রহমান বলেন, নানা কারণে শিশুরা টার্গেট হচ্ছে। অনেকে আগ্রাসী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ চরমভাবে প্রকাশ করছে। আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব অনেকের মধ্যে নেতিবাচক পড়ছে। কেউ আবার স্বল্প সময়ে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হতে চায়। এ ছাড়া সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। তাই শিশুদের হত্যা করেও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছে।
সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রোকন উদ-দৌলা (বর্তমানে যুগ্মসচিব, পরিচালক (আইন) রাজউক) বলেন, আমাদের সকলের চরিত্রের মধ্যে হিংস্র মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সামাজিক মূল্যবোধ, উপযুক্ত সাক্ষ্য ও যথাযথ প্রমাণের অভাবে অনেক মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায়না। এটা রোধ করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের প্রতি মায়া মহব্বত ও সহজাত মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি নিজ বিবেককে সচেতন করতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলীর মতে, শিশু নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাও বাড়াতে হবে। রাজন বা রাকিব হত্যার বিচার নয়, সব শিশু হত্যার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
সূত্র মতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিশু হত্যার হার ছিল ক্রমবর্ধমান। ২০১৫ সালে এই হার ২০১৪ সালের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। ২০১৬ সালে তা বেড়ে আকাশচুম্বি হচ্ছে বলেই ধরে নেয়া যায়। চলতি বছরে প্রায় প্রতিদিনই শিশু হত্যার ঘটনা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অেেনক। বিশিষ্টজনরা বলছেন, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কেউ তাদের হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারছে না। একের পর এক শিশুহত্যার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আমাদের সমাজের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের দাবি শিশু নির্যাতনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সাহস না পায়, সেজন্য শিশু নির্যাতনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন