মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

অধিকার ও দায়িত্ব

| প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুফতি মুহাম্মাদ শফি (রহ.) : বর্তমান দুনিয়ায় প্রচলিত বিভিন্ন সংবিধানে সাধারণত মৌলিক অধিকারের উপর একটি অধ্যায় রাখা হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআন সূরা নিসার ১৫ ও ১৬ নং আয়াতে প্রচলিত এ পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে প্রথমোক্ত আয়াতে শাসক ও ক্ষমতাশীলদের এবং দ্বিতীয় আয়াতে জনসাধারণকে সম্বোধন করে উভয় দলের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করে দিয়েছে। উভয় দলের অধিকারসমূহ বর্ণনা করার স্থলে উভয় দলের দায়িত্ব বর্ণনা করে আল কুরআন যেন মৌলিক অধিকারের স্থলে মৌলিক দায়িত্বের অধ্যায় সংস্থাপন করেছে। এর দ্বারা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপদেশ এই হাসিল হয়েছে যে, প্রতিটি দল ও উপদলকে অধিকার আদায় নয়, বরং তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে যেন উদ্বুদ্ধ করা হয়। আম-জনতার অধিকার আদায়ের এর চেয়ে উত্তম বিকল্প কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। কেননা এক শ্রেণীর মানুষের অধিকার অন্য শ্রেণীর দায়িত্ব হয়ে থাকে। মানুষের প্রতিটি শ্রেণী যদি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের চিন্তায় বিভোর থাকে তাহলে সকলের অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পন্ন হয়ে যায়। যেমন মাতা-পিতার দায়িত্ব হলো, নাবালক সন্তান-সন্ততির লালন-পালন ও ভরণ-পোষণ করা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আমল-আখলাক সুন্দর করার যথাসাধ্য ব্যবস্থা করা। মাতা-পিতার এসব দায়িত্বই সন্তানের অধিকার। অনুরূপভাবে সন্তানের দায়িত্ব হলো মাতা-পিতার আনুগত্য ও সেবা-যতœ করা। আর এগুলোই মা-বাবার অধিকার। এমনিভাবে স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর অধিকার এবং স্ত্রীর দায়িত্ব স্বামীর অধিকার হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে জনসাধারণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের অধিকার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনসাধারণের অধিকার হয়ে থাকে। যদি মানুষের প্রতিটি শ্রেণী নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝে যথাযথভাবে তা পালন করে তাহলে অধিকার আদায়ের ঐ ¯েøাগান ও হাঙ্গামা যা ব্যক্তিজীবন থেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সমগ্র দুনিয়াকে ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও লড়াই-যুদ্ধের নরক বানিয়ে দিয়েছে তা পুরোপুরিভাবে খতম হতে পারে ও যুলুম-নির্যাতনে ফেঁসে যাওয়া মজলুম মানবতা শান্তি ও নিরাপত্তার শ্বাস নিতে পারে।
এ উপদেশনামার আলোকেই রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি ঝগড়া-বিবাদের প্রাথমিক ফায়সালা এ পদ্ধতিতে করার উপর চিন্তা করতেন যাতে মানুষ অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার পরিবর্তে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেতন হয়। এক পুত্র রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তার পিতার ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করলে তিনি তাকে নির্দেশ দিলেন, “তোমার পিতা যদি তোমার উপর যুলুম করে তাহলেও তুমি তার খেদমত এবং আনুগত্য কর।” জনৈক স্ত্রী তার স্বামী সম্পর্কে দরবারে নববীতে অভিযোগ দায়ের করলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “স্ত্রীগণ তাদের স্বামী সম্পর্কে অভিযোগ করবে এটা আমার পছন্দ নয়।” এক স্বামী তার স্ত্রী সম্পর্কে অভিযোগ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “নারীর মধ্যে কিছুটা বক্রতা অবশ্যই আছে। তার দ্বারা কাজ নিতে হলে ধৈর্য ধরতে হবে এবং এ অবস্থায়ই নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
মুসলমানদের নিকট থেকে বিভিন্ন দান-অনুদান, সদকা ও যাকাত উসূলকারী তহসিলদার ও কর্মকর্তাগণকে যখন নিজ নিজ এলাকার যাকাত উসূল ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করার জন্য পাঠানো হতো তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে জোর নির্দেশ দেয়া হতো যেন তারা দায়িত্ব পালনকালে কোন ব্যক্তিকে হয়রানি না করে। কারো নিকট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যতীত বেশি যেন উসূল না করে। আমলাগণ যেন এক জায়গায় বসে যাকাত বা দান-অনুদান প্রদানকারীদেরকে মাল-সম্পদ তাদের নিকট কষ্ট করে নিয়ে আসতে বাধ্য না করে, বরং তারা নিজে যেন লোকদের ঘরে ঘরে গিয়ে হিসাব মোতাবেক যাকাত বা অন্যান্য দান-অনুদান উসূল করে। হাদিসের লা জালাবা ওয়ালা জানাবা এবং ইয়্যাকুম ওয়া কারাইমাহু এ জাতীয় নির্দেশনারই অন্তর্ভুক্ত। এ নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয় কিনা তার উপর চৌকস দৃষ্টি রাখা হতো।
ভিন্ন একটি চিত্রের দিকে নজর দেয়া যাক। একবার কতিপয় ব্যক্তি দরবারে নববীতে এসে তহসিলদার ও কর্মকর্তাগণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে বললেন, তারা আমাদের উপর যুলুম করে। তখন তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়, “তোমরা যাকাত ও অন্যান্য দান-অনুদান উসূলকারী ব্যক্তিদেরকে সন্তুষ্ট করো যাতে তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে প্রত্যাবর্তন করে।” মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ করার এ পদ্ধতির ফল অতি অল্পদিনেই লোকদের সামনে প্রকাশ পায়। একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার স্থলে অভাবিতপূর্ব এমন দৃশ্য দরবারে নববীতে পরিলক্ষিত হয় যে, বকরির মালিক তার বকরির যাকাত আদায়ে একটি উচ্চমানের বকরি পেশ করে আর যাকাত উসূলকারী তহসিলদার ব্যক্তি বলে তোমার দায়িত্বে ওয়াজিব হওয়া বকরির মূল্যের চেয়ে এর মূল্য বেশি, এর চেয়ে কম মূল্যের বকরি দাও! যাকাত প্রদানকারী বলে আমি তাই দেব! উসূলকারী তহসিলদার কর্মকর্তা বলে আমি এটা নিতে পারব না। তখন বিবদমান এ ঝামেলার নিষ্পত্তির জন্য দরবারে নববীতে এ জাতীয় ঝগড়ার মামলা দায়ের করা হয় যে, যাকাত প্রদানকারী বেশি প্রদান করতে চায় কিন্তু গ্রহণকারী আমলা তা গ্রহণ করে না। এ বরকত ঐ ইসলামী মূলনীতিসমূহের ছিল যা মানুষকে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার পরিবর্তে দায়িত্ব পালনে সচেতন করে তুলেছিল এবং এ ক্ষেত্রে খোদাভীতি দ্বারা কাজ নিতে চেয়েছিল।
একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, দরবারে নববী থেকে এ জাতীয় দিক-নির্দেশনার উদ্দেশ্য এই হতে পারে না যে, কোন এক শ্রেণীর মানুষের যুলুমকে বৈধ রাখা হবে এবং উভয় শ্রেণীকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেওয়া হবে, বরং উভয় শ্রেণীকে ভিন্ন ভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল যাতে উভয় শ্রেণী অধিকার আদায়ের ¯েøাগান দেয়ার পরিবর্তে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হয় এবং পুরো সমাজের আখলাক ও হিম্মত বুলন্দ হয়। সাথে সাথে অধিকার আদায়ের ঝগড়ার স্থলে মন-মানসে এই চিন্তা স্থানলাভ করে যে, যাকাত বা অনুদান প্রদানে যেন কম না হয়ে যায়, অপরদিকে এসব দান-অনুদান উসূলে বেশি যেন গ্রহণ না হয়। অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ফায়সালা কেবল বিচারপতি বা শাসকসুলভ ছিল না, বরং তার দিক-নির্দেশনা ছিল দরদি অভিভাবকসুলভ। আর যখনি এসব দিক-নির্দেশনার বিপরীতে কাজ করার উপর কোন মামলা দায়ের করা হয়েছে তখনি এর চুলচেড়া বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
মোট কথা সূরায়ে নিসার আলোচ্য দুই আয়াতে শাসকদল ও জনসাধারণের দায়িত্ব বর্ণনার পর শাসকদেরকে একটি বিশেষ পলিসির নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে মানুষের প্রতিটি শ্রেণীকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেতন করে তোলা হয় এবং দাবি আদায় ও অনাদায়ের ঝগড়া যে স্থানে সৃষ্টি হয় সেখানেই তা বন্ধ হয়ে যায়। যতদিন পর্যন্ত এসব ইসলামী দিক-নির্দেশনার উপর আমল করা হয়েছে ততদিন পর্যন্ত আদালতে মামলা দায়ের হওয়ার ঘটনা খুব কমই পরিলক্ষিত হয়েছে। আর যখনি এসব মূলনীতি থেকে বিমুখতা অবলম্বন করা হয়েছে তখনি মামলা-মোকাদ্দমার পরিসংখ্যান বহুগুণে বেড়ে গেছে, যা অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অজানা নয়। (বিখ্যাত ‘আমনে আলম কী হাইছিয়ত’ মাকালা/ প্রবন্ধ থেকে অনুদিত)
অনুবাদ : আবদুল কাইয়ুম শেখ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
আবদুল কাইয়ুম শেখ ২৮ মার্চ, ২০১৭, ৭:২৭ এএম says : 0
লেখাটি প্রকাশ করায় বিভাগীয় সম্পাদকসহ ইনকিলাব পরিবারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি!
Total Reply(0)
আবদুল কাইয়ুম শেখ ২৮ মার্চ, ২০১৭, ৭:২৯ এএম says : 0
লেখখাটি প্রকাশ করায় বিভাগীয় সম্পাদকসহ ইনকিলাব পরিবারের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি!
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন