পঞ্চায়েত হাবিব : জাতীয় সংসদে ৭১ জন নারী সংসদ সদস্য থাকলেও আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেছেন মাত্র ৪ জন। সংসদ অধিবেশন শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয় প্রশ্নোত্তর পর্বেও নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম বলে জানিয়েছে টিআইবি।
সংসদ পরিচালনায় স্পিকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। গতকাল রোববার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কার্যালয়ে ‘পার্লামেন্টওয়াচ- দশম জাতীয় সংসদ : সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশন’র জেন্ডার বিশ্লেষণ: সংসদীয় কার্যক্রমে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন আলোচনায় মাত্র ৪ জন নারী সংসদ সদস্য অংশগ্রহণ করেন। যা মোট নারী সদস্যের ৭ শতাংশ। যেখানে ছিলেন একজন নির্বাচিত ও তিনজন সংরক্ষিত আসনের সদস্য। বাকি সদস্যদের কেউ আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেননি। তুলনামূলকভাবে আইন প্রণয়নে পুরুষদের অংশগ্রহণ ছিল শতকরা ১২ ভাগ। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে ৭ জন নারী সংসদ সদস্য অংশগ্রহণ করেন। তারা প্রশ্ন উত্থাপন করেন ১৮টি। অংশ নেয়া সদস্যদের মধ্যে ৪ জন নির্বাচিত ও ৩ জন সংরক্ষিত আসনের। তবে দশম সংসদে মোট সময়ের তিন-চতুর্থাংশে মধ্যে নারী সদস্যদের উপস্থিতি ছিল শতকরা ৬১ ভাগ। যেখানে পুরুষদের উপস্থিতি শতকরা ৩৪ ভাগ। এছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে স্থান পান ৬৮ জন নারী সংসদ সদস্য। তবে স্পিকার, সংসদ নেতা ও বিরোধী দলের নেতাদের এর মধ্যে ধরা হয়নি।
প্রতিবেদনে সংসদ পরিচালনায় স্পিকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। এতে বলা হয়েছেÑ সংসদ সদস্যদের অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার অব্যাহত, একজন সরকার দলীয় এবং একজন বিরোধী দলীয় সদস্যের বক্তব্যের অসংসদীয় শব্দ এক্সপাঞ্জ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সতর্কবাণী প্রদান ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পিকারকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। বিধি অনুযায়ী অধিবেশন চলাকালে গ্যালারীতে শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতিও লক্ষণীয়।
সংসদ কার্যকর হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের গবেষণা অনুযায়ী, সংসদ কার্যকর হয়েছে এই উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। আমরা বিভিন্ন তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলেছি বিরোধী দল ওয়াক আউট করেনি, সংসদ বর্জন করেনি। তারা আগের থেকে বেশি সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। তারা কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অন্যদিকে সংসদ কার্যকর হওয়ার জন্য জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সংসদ পরিচালনা কথা থাকলে এখনো তেমনটি হয়নি। সংসদে অশালিন ভাষার ব্যবহার ও আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। অতীতের মতো এই সংসদের ওপরও সরকারের আধিপত্য রয়েছে।
বিরোধী দলের ভূমিকা কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, প্রধান বিরোধীদল সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের কথাগুলো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তাদের উত্থাপিত সমস্যাগুলো সুরাহা করা হয়নি। বিরোধী দলের দ্বৈতমুখিতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি সংসদ অধিকতর কার্যকর ও সংসদে জনগণের দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বিরোধীদলের স্পষ্ট অবস্থান, কমিটিসমূহের সুপারিশ আমলে নেয়া ও সংসদের উপর সরকারের আধিপত্য কমানোর আহŸান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদ কার্যক্রমে নারী সদস্যদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের বর্ধিত প্রচেষ্টা বিষয়গুলো সংসদীয় কার্যক্রমের সক্রিয়তা বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই অধিকতর অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে। তিনি সংসদ সদস্যদের বিব্রতকর শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত হওয়া, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আমলে নেয়া, কমিটিসমূহে দৃশ্যমান স্বার্থের দ্ব›দ্ব কমিয়ে আনা ও সংসদীয় উন্মুক্ততা ঘাটতি নিরসনসহ টিআইবি’র সুপারিশ আমলে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহŸান জানান।
ট্আিইবি উত্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে সংসদীয় গণতন্ত্র সুদৃঢ় করা, সংসদকে কার্যকর করা ও সর্বোপরি সংসদকে জবাবদিহিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে সংসদে সদস্যদের উপস্থিতি, সংসদে সদস্যদের আচরণ ও অংশগ্রহণ, তথ্য প্রকাশ, সংসদীয় কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, সংসদীয় কমিটি কার্যকর করাসহ মোট ১১ দফা সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। সেখানে ‘সংসদ সদস্য আচরণবিধি বিল’ চূড়ান্ত অনুমোদনের উদ্যোগ গ্রহণ; অসংসদীয় আচরণ এবং ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের অধিকতর শক্তিশালী ভ‚মিকা পালন; দ্বৈত অবস্থান পরিহার করে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ইতিবাচক চর্চাকে কার্যকর করা; সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসমূহকে কার্যকর; আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে সদস্যদের অধিকতর অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং আইন প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে জনগণের অধিকতর অংশগ্রহণের জন্য জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করার আহŸান জানানো হয়েছে। এছাড়াও জনগণের সাথে সংসদের সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য পিটিশন কমিটিকে কার্যকর করা; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনসহ সদস্যদের মত প্রকাশ ও সমালোচনার বিধান এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ সদস্যদের আলোচনার বিধান গ্রহণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ কার্যবিবরণী সরকারি ও বেসরকারি রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রসহ সকল গণমাধ্যমে সহজলভ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দশম সংসদের ৭টি অধিবেশনে দৈনিক গড়ে ২৮ মিনিট হিসেবে মোট কোরাম সংকট হয়েছে ৪৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট যার অনুমিত অর্থমূল্য প্রায় ৪৭ কোটি ২০ লাখ ৩৩ হাজার ২০৪ টাকা। অধিবেশনে আইন প্রণয়নে মোট অধিবেশনের সময়ের মাত্র ১৬ শতাংশ ব্যয়িত হয়েছে।
সুপারিশ বিবেচনার আশ্বাস স্পিকারের : জাতীয় সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে টিআইবি’র সুপারিশ বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে নিজের কার্যালয়ে ইনকিলাবকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ থাকলে তা অবশ্যই বিবেচনা করা হবে। সংসদ অধিবেশনে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিৎ এবং সেবিষয়ে তিনি সতর্ক রয়েছেন বলে জানান। স্পিকার বলেন, সংসদ সদস্যরা তাদের বক্তব্যে কী বলবেন, সেটা একান্তই তাদের বিষয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কথা না বলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বোঝা যায় না, তারা কী বলছেন। তবে কার্যপ্রণালীবিধির বাইরে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার হলে অবশ্যই আমরা আপত্তি জানাই। অনেক ক্ষেত্রে এক্সপাঞ্জও করা হয়েছে। অনেক সময় অধিবেশন কক্ষে এক্সপাঞ্জ না হলেও যাচাই-বাছাই শেষে অসংসদীয় ও আপত্তিকর ভাষা এক্সপাঞ্জ করা হয়। তিনি আরো বলেন, বক্তব্য দেয়ার বিষয়ে সংসদ সদস্যদেরও সচেতন হতে হবে। আগের তুলনায় এ অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আগামীতে আরো হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন