রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

হারাম সম্পদের পরিণতি ও তার প্রতিকার

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

\ চার \
ডাকাত শব্দের অর্থ দস্যু, লুণ্ঠনকারী, বলপূর্বক অপহরণকারী, অসম সাহসী ও নির্ভীক এবং ডাকাতি শব্দের অর্থ হল: দস্যুবৃত্তি, দস্যু দ্বারা লুণ্ঠন, অসম সাহসিক ও বিস্ময়কর দুষ্কর্ম ইত্যাদি
যেসব লোক সশস্ত্র হয়ে পথে-ঘাটে, ঘরে-বাড়িতে, নদীতে-মরুভূমিতে নিরন্ত্র মানুষের উপর হামলা চালায় এবং প্রকাশ্যভাবে জনগণের সম্মুখে জনগণের ধন-মাল হরণ করে নিয়ে যায়, তাদেরকেই বলা হয়েছে ডাকাত, লুণ্ঠনকারী বা মুহারিবুন।
বাংলাদেশ দন্ডবিধির ভাষ্যে বলা হয়েছে, ‘‘যদি চুরি করিবার উদ্দেশ্যে বা চুরি করিতে কিংবা চুরিতে লব্দ সম্পত্তি বহন বা বহনের উদ্যোগকালে অপরাধকারী তদুদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় বা আঘাত করে কিংবা আটক করে ভীতি প্রদর্শন করে তাহলে উক্ত চুরিকে দস্যুতা বলে।’’
আর সেই ক্ষেত্রে ৫ বা ততোধিক ব্যক্তি মিলিত হইয়া কোন দস্যুতা অনুষ্ঠান করে বা করিবার উদ্যোগ করে তাহা হইলে তাকে ডাকাতি বলে।
যারা ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ ছিনিয়ে নেয় এবং ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষের জীবন ও সম্ভ্রমহানী ঘটায় তাদের ক্ষেত্রে আল-কুরআনের সরাসরি শাস্তির ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন: ‘‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ করে বেড়ায়, তাদের আযাব কেবল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। এটি তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।’’
ডাকাতি প্রতিরোধে মুমিনদের এগিয়ে আসতে হবে। কোথাও ডাকাতির ঘটনা ঘটলে মুমিন নির্বিচার থাকতে পারে না। কেননা এটা ঈমানের পরিপন্থী আচরণ। এ প্রসঙ্গে নবী স. বলেছেন: ‘‘যখন কোনো লোক কোন মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয় আর লোকেরা তা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তখন সে আর মুমিন থাকে না।’’
অতএব ডাকাতি সুস্থ সমাজব্যবস্থার পক্ষে খবুই ক্ষতিকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। এ কারণে ইসলামী আইনে ডাকাতি জঘন্য অপরাধ। ইসলামী সমাজে ডাকাতির কোন সুযোগ থাকতে পারে না। ডাকাতির পথও কারণ সর্বতোভাবে বন্ধ করা একান্তই আবশ্যক।
ইসলাম বিধান মতে ডাকাতির শাস্তি অপরাধভেদে কমবেশী হতে পারে। শাস্তির বিধান প্রয়োগ করার ব্যাপারে ইসলামী সরকারের স্বাধীনতা রয়েছে। অর্থাৎ বিচারক ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করতে পারবে, শূলে চড়াতে পারবে এবং বহিষ্কার করতে পারবে। এই মতটি ইবনে আব্বাস, হাসান, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব ও মুজাহিদের। যে ডাকাত হত্যা ও সম্পদ হরণ এই দুই অপরাধই করে তাকে হত্যা করা হবে অতঃপর শূলে চড়ানো হবে। যে ডাকাত সম্পদ কেড়ে নেবে কিন্তু কাউকে হত্যা করবে না, তাকে শুধু হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কাটা হবে। যে ডাকাত শুধু রক্তপাত করবে এবং সম্পদ হরণ করবে না তাকে হত্যা করা হবে।
আর যে ব্যক্তি হত্যাও করবে না, সম্পদও হরণ করবে না, কিন্তু অস্ত্র নিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করবে, তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। এটি শাফেঈ মাযহাবের মত। ইমাম শাফেঈ আরো বলেন, প্রত্যেককে তার অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তি দেয়া হবে। হত্যা ও শূল দুটোই যার প্রাপ্য, তাকে প্রথমে হত্যা করা হবে অথবা ৩ বার শুলে চড়িয়ে নামিয়ে রাখা হবে যাতে তার শাস্তি কে খুবই ঘৃণ্যভাবে প্রকাশ করা যায়। আর যার কেবল হত্যার শাস্তি প্রাপ্য তাকে হত্যা করে লাশ আপনজনদের হাতে অর্পণ করতে হবে।
আল-কুরআন এর ঘোষণা ‘‘অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে’’-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস রা. বলেন: যাকে ধরা সম্ভব হবে না তার সম্পর্কে সরকার ঘোষণা দিয়ে দেবেন যে, যে ব্যক্তি তাকে ধরতে পারবে, সে যেন তাকে হত্যা করে। আর যে ধরা পড়বে, তাকে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করতে হবে। কেননা এতে করে অপরাধ বন্ধ হবে এবং এটাই তার বহিষ্কার। শুধু হত্যার ভয় দেখানো এবং সন্ত্রাস ছড়ানোই কবীরা গুনাহ। এর ওপর কেউ যদি জিনিসপত্র ছিনতাইও করে এবং খুন-জখমও করে, তবে সে তো এক সাথে অনেকগুলো কবীরা গুনাহ সংঘটিত করে। এ ছাড়া এ ধরনের অপরাধিরা সাধারণত মদখোরী, ব্যভিচার, সমকাম, নামায তরক ইত্যাদি কবীরা গুনাহেও লিপ্ত থাকে।
বাংলাদেশ দন্ডবিধির ভাষ্যে বলা হয়েছে, যদি কোন লোক উপরে বর্ণিত ডাকাতির সংজ্ঞায় বর্ণিত কর্মকান্ডে জড়িত থাকে তাহলে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৯২ ধারা মোতাবেক ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইতে পারে। “গাজী শামছুর রহমান, দন্ডবিধির ভাষ্য, ধারা-৩৯২।” আর এ ডাকাতি যদি প্রকাশ্য রাজপথে সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে তার শাস্তির মেয়াদ ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। মানব পাচার ও অপহণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা ইসলাম ও প্রচলিত আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অপহরণ একটি জঘন্য অপরাধ। রসূল স. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘‘তোমাদের এ শহরে আজকের দিন ও এ মাসের মতই তোমাদের পরস্পরের জীবন, সম্পদ ও সম্মান সম্মানীয়। প্রত্যেক মানুষকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে চলতে দিতে হবে। এটা তার অধিকার। অপহরণের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনভাবে চলার অধিকারকে হরণ করা হয়। তাছাড়া অপহরণকারী অপহৃত ব্যক্তিকে সাধারণত যেহসব কাজে নিয়োজিত করে তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনৈতিক ও অমানবিক। তাই এ অপরাধের সাথে জড়িত প্রায় সব দিক অবৈধ। আর অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা একটি প্রতারণা। ইসলামী আইনে সকল প্রকার প্রতারণা হারাম। প্রতারণা ও ধোঁকাবাজীকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে আল্লাহ্ বলেন: আর এভাবেই আমি প্রত্যেক জনপদে এর শীর্ষস্থানীয় অপরাধী লোকদেরকে এমনই করেছি যেন তারা নিজেদের ধোঁকা, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। “আল-কুরআন, ৬:১২৩।” এ প্রসঙ্গে রসূল স. বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’’
অপহরণ শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি জঘন্য অপরাধ। তাই ইসলামে অপহরণের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। আর অপহরণের ক্ষেত্রে সাধারণত চুরি ও প্রতারণাই প্রধান কৌশল হিসেবে অনুসৃত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে যে কৌশলই অবলম্বন করা হোক না কেন, সার্বিকভাবে ইসলাম তা অবৈধ বলে সাব্যস্ত করেছে। কোন মানুষকে বিক্রি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এমন কি নিজের সন্তানকেও বিক্রি করার কারো অধিকার নেই। কেননা, মানুষ অতীব সম্মানীয়। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।
প্রচলিত আইনের দন্ডবিধির ভাষ্যে বলা হয়েছে: যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে কোন স্থান হতে গমন করিবার জন্য জোরপূর্বলক বাধ্য করে বা কোন প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ করে সেই ব্যক্তি উক্ত ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে বলিয়া গন্য হইবে। যদি কোন লোক উক্ত অপরাধে অপরাধী হয় তাহলে তার শাস্তির মেয়াদ সাত বছর কারাদন্ড এবং তদুপরি অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। যে ব্যক্তি অভ্যাসগতভাবে দাস আমদানি, রপ্তানি, অপহরণ, ক্রয়-বিক্রয় করে বা দাসের কারবার করে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা যে কোন বর্ণনার অনূর্ধ্ব দশ বছর মেয়াদী কারাদন্ডে তদুপরি অর্থে দন্ডিত হবে।
এ সম্পর্কে ২০০০ সালে জাতীয় গেজেটের ৮ নং আইনের ৭ ধারায় নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি ধারা-৫ এ উল্লিখিত কোন অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে কোন নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অন্যূন চৌদ্দ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডে ও দন্ডনীয় হইবে। যদি কোন ব্যক্তি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোন নারী বা শিশুকে আটক করেন, তা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন