সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম : আধুনিক বিশ্বে রাজনীতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ‘জনগণের কল্যাণ নিশ্চিতকরণ’ বলা হলেও বাস্তবতা হলো- জনগণ রাজনীতির কষাঘাতে কখনো হচ্ছে কুপোকাত আবার কখনো এর বদৌলতে ফিরে পাচ্ছে সুন্দর, সুখময় হায়াত। কখনো এক শ্রেণির জনগণ রাজনীতির সুফল ভোগ করছে তো অপর শ্রেণির জনগণকে হতে হচ্ছে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত এমনকি নিহত। সর্বত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় কার্যসিদ্ধি, রাজনৈতিক হানাহানি ও প্রতিহিংসার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটায় সাধারণ জনমনে আজ রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ইসলাম রাজনীতি সম্পর্কে অতি উন্নত ধারণা প্রদান করেছে। রাজনীতি যে নোংরামি কিছু নয়; বরং এটি যে জনগণের জন্য কল্যাণকর একটি ব্যবস্থাপনা, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে।
ইসলামে রাজনীতির পরিচয়
সাধারণ অর্থে রাষ্ট্রশাসনের বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে রাজনীতি বলা হয়। তবে ইসলামে রাজনীতির পরিচয় একটু ব্যাপক ও বিস্তৃত। রাজনীতি শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘আস্ সিয়াসাহ’। শব্দটি ক্রিয়াপদ হিসেবে কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
০১. সুষ্ঠু সমাধান গ্রহণ করা; আরবিতে ‘সাসাল আমরু সিয়াসাতান’ বলতে কোন বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান গ্রহণ করাকে বুঝায়।
০২. পরিচালনা করা; তাই ‘সাউওয়াসাহুল কওমা’ বলতে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করাকে বুঝায়। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কানা বানূ ইসরাঈলা ইউসাওবিসুহুম আম্বিয়ায়াহুম’ তথা বনী ইসরাঈলকে তাদের নবীগণই পরিচালনা করতেন।
০৩. পথ-নির্দেশনা দান; যেমন আরবিতে বলা হয়: ‘সুসতুর রায়িয়াতা সিয়াসাতান’ অর্থ: আমি জনগণকে পথ-নির্দেশনা দিয়েছি।
০৪. শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া; বিখ্যাত আরবি অভিধান ‘আল কামূস আল মুহীত’-এ বলা হয়েছে: ‘কদ সাসা আলাইহি’ দ্বারা তিনি তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন বুঝানো হয়।
রাজনীতি শব্দের উপর্যুক্ত অর্থগুলো বিশ্লেষণ করলে জানা যায় যে, রাজনীতি হলো বিশৃঙ্খলা পরিহার করে সুষ্ঠু সমাধানকল্পে শিষ্টাচার শিক্ষা, পথ-নির্দেশনা দান, সংস্কার, সুসংহত, সুশৃঙ্খল ও শান্তি নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা বা পদ্ধতি।
পরিভাষায় ‘সিয়াসাহ’ বা রাজনীতি বলতে সাধারণত জনগণ পরিচালনার নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধানকে বুঝানো হয়ে থাকে। ইবন কুতায়বা তার ‘আল ইমামাহ ওয়াস্ সিয়াসাহ’ গ্রন্থে, আল মাওয়ারদী তার ‘আল আহকামুস সুলতানিয়্যাহ’ গ্রন্থে এ অর্থেই রাজনীতির পরিচয় প্রদান করেছেন। মুসলিম পÐিত ও রাজনীতিবিদগণ পারিভাষিক অর্থে রাজনীতির পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে:
০১. ইবনু নাজীম (রহ.) বলেন, রাজনীতি হলো- কোন বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানকল্পে শাসক কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ। গৃহীত এ পদক্ষেপের ব্যাপারে শরয়ী কোনো প্রমাণ নাও থাকতে পারে।
০২. ইবনু আকীল (রহ.) বলে, মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং বিশৃঙ্খলার পথ পরিহার করাই হলো রাজনীতি। এ নীতি হুবহু রাসূল (সা.) কর্তৃক গৃহীত ও অহী নাযিলের মাধ্যমে অবধারিত নাও হতে থাকে।
০৩. ইবনু খালদূন (রহ.) বলেন, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণ অর্জনের জন্য শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সকল দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করাই হলো রাজনীতি।
০৪. আব্দুর রহমান তাজ বলেন, রাজনীতি হলো সে সব বিধি-বিধান, যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত ও জাতি পরিচালিত হয় এবং যে বিধান শরিয়তের মূলনীতির সাথে একাত্মতা ও সামাজিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রাখে। তবে এ সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাতে বিস্তারিত বর্ণনা নাও থাকতে পারে।
উপর্যুক্ত পারিভাষিক সংজ্ঞাগুলোর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, ইসলামে রাজনীতি হলো এমন এক ব্যবস্থাপনা বা বিধানমালা, যা ইসলামি শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণ, শরিয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে একাত্মতা পোষণ এবং কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা’ ও কিয়াসের পরিপন্থীনীতি বর্জন করে শরিয়ত স্বীকৃত স্বার্থ নিশ্চিতকরণে শরয়ী পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতৃত্বের ভিত্তিতে দেশ ও জনগণ পরিচালনার অঙ্গিকারে অঙ্গিকারাবদ্ধ।
ইসলামে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা [পড়সঢ়ষবঃব পড়ফব ড়ভ ষরভব] হিসেবে এতে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সম্পর্কে রয়েছে কালজয়ী আদর্শ। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ “আমি আমার এ গ্রন্থে (আল কোরআনে) বর্ণনা বিশ্লেষণে কোনো কিছুই বাকি রাখিনি” (সূরা আল আন‘আম: ৩৮)। সঙ্গতকারণে, এতে রাজনীতি সম্পর্কীয় আলোচনা স্থান পাবেÑ এটাই স্বাভাবিক। গবেষণায় দেখা গেছে যে, রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে ইসলাম শ্বাশ্বত ও বিশ্বজনীন নির্দেশনা তুলে ধরেছে এবং জনগণকে ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ বেশ কিছু রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করেছে। নি¤েœ ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণের রাজনৈতিক অধিকারগুলো সংক্ষেপে আলোচিত হলো:
০১. সরকার নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অধিকার : সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। আর এ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে সুচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য জনগণকর্তৃক নির্বাচিত সরকার থাকা অপরিহার্য। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক পরিমÐলে ইসলাম জনগণকে ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের অধিকার প্রদান করেছে। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (হে ঈমানদারগণ!) আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা হাজ্ব : ৭৫)। কাজেই জনগণের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হবে। জনগণের ভোটাধিকার খর্ব করে অসৎ উপায় বা পন্থা অবলম্বন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া কোনোক্রমেই বৈধ নয় এবং তা রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
অন্যদিকে ইসলাম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য তিনটি গুণের প্রতি প্রাধান্য দিয়ে সরকার নির্বাচন করার জন্য জনগণকে আহŸান জানিয়েছে। গুণ তিনটি হলো- এক. তাক্ওয়া ও ন্যায়-পরায়ণতা, দুই. নেতৃত্ব প্রদান ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা, তিন. প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা, দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
০২. জনস্বার্থে সরকারকে দিক-নির্দেশনা প্রদানের অধিকার : মাজলিসে শুরা বা মন্ত্রীপরিষদ, সংসদ সদস্য ও আমলা ছাড়াও সাধারণ জনগণ অকপটে শাসক বা সরকারকে নানা বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের অধিকার রাখে। এ নির্দেশনা, অভিমত বা পরামর্শকে সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন। প্রয়োজনে জনগণের সাথে পরামর্শ করবেন। এ দিকে ইঙ্গিত করে রাষ্ট্র প্রধান রাসূল (সা.)কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর আপনি কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালবাসেন। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯)।
ড. মাহমুদ আব্দুল মাজীদ আল খালিদী তার ‘কাওয়ায়িদু নিযামিল হুকুম ফিল ইসলাম’ (ইসলামে শাসন ব্যবস্থার নীতিমালা) নামক বিখ্যাত গ্রন্থে বলেন, শুরা বা পরামর্শ দানের ক্ষমতা শুধু মাজলিসে শুরা বা সংসদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আয়াতে বর্ণিত শুরা বা পরামর্শ দানের অধিকার মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্য সংরক্ষণ করেন। (কাওয়ায়িদু নিযামিল হুকুম ফিল ইসলাম, পৃ.১৪২)।
০৩. সরকারি কর্মকাÐের সমালোচনা করার অধিকার : সমালোচনা করা আর নিন্দা ও কুৎসা রটনা এক বিষয় নয়। সমালোচনা হলো কোনো কিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যুক্তি, প্রমাণাদি দিয়ে ভাল-মন্দের যাচাই করা। সরকারকর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মকাÐের পর্যালোচনা করে তার সুফল বা কুফল তুলে ধরার অধিকার জনগণের রয়েছে। জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম থেকে নিবৃত হওয়ার জন্য সরকারের সামনে জোরালোভাবে অকপটে হক কথা তুলে ধরাকে ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, সাবধান, কারো যদি সত্য জানা থাকে, তাহলে মানুষের ভয়ে যেনো সত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত না থাকে।” (জামে’ আত তিরমিযী)। অপর একটি হাদীছে রাসূল (সা.) বলেন, সর্বোত্তম জিহাদ হলো অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা। (মুসনাদে আহমাদ)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন