শেখ দরবার আলম
\ এক \
প্রথমেই উল্লেখ করে নেয়া ভালো যে, আমার সীমাবদ্ধতার অনেকগুলো দিক আছে। আমার সীমাবদ্ধতার একটা দিক হলো এই যে, আমি নিজে যা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে পারি না তা লিখতে পারি না। খুব ভালোভাবে না জেনে বা না বুঝে কিছু লিখতে পারি না। যারা মেহেরবানী করে আমার লেখা পড়বেন বা আমার লেখার বিচার করবেন তারা অনুগ্রহ করে আমার এই কথাটা স্মরণের রাখলে আমার প্রতি সুবিচার করতে পারবেন। আমি মনে করি এই সুবিচারটা আমার পাওনা হয়।
শৈশবে খুবই সামান্য একটু জ্ঞান-গম্যি হওয়ার সময় থেকেই পহেলা বৈশাখের কথাটা নিজেদের পরিবার থেকেই শুনেছি। পহেলা বৈশাখে দোকানে দোকানে হালখাতা হবে। পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন দোকান থেকে লাল কালিতে ছাপা কার্ডে নিমন্ত্রণপত্র আসতো। দোকানে দেনা থাকুক কিংবা না থাকুক, পহেলা বৈশাখের হালখাতার দিনে দোকানদারকে কিছু টাকা দিলে তিনি তাঁর খাতায় লিখে রাখতেন এবং একটা মিষ্ঠির ঠোঙা দিতেন। ছোটবেলায় এই মিষ্টির প্রতি আমাদের ছোটদের একটা আকর্ষণ থাকতো মাছ-গোশতের থেকেও অনেক বেশী। আমার কাছে তখন এরকমই একটা অত্যন্ত সহজ-সরল এবং আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল পহেলা বৈশাখ!
\ দুই \
তারপর সেই শৈশব, বাল্য এবং কৈশোর পেরিয়ে এক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় এলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইকবাল হলে থাকি। সেটা ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালের কথা। পহেলা বৈশাখের খুব ভোরে চলে যেতাম রমনা পার্কে। দেখতাম এক সময়কার শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সনজীদা খাতুন কয়েকজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাচ্ছেন। তখন রমনা পার্কে ওই সময় আসতেন সামান্য কয়েকজন লোক। হাতেগুনে তাদের সংখ্যা বলে দেওয়া যেত। তখন পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মঙ্গল শোভাযাত্রা-তাত্রা কিছু হতো না! ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে এসব কিছুই তো ছিল না।
২৮ মার্চ ১৯৯৮ তারিখ শনিবার ঢাকার দৈনিক জনকণ্ঠে “রাজনীতির লোক? না সংস্কৃতির?” শীর্ষক স্মৃতিকথায় অনুশীলন সমিতি (১৯০২)-এর সভ্য মান সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির যুগান্তর দল (১৯০২)-এর সভ্য সত্যেন সেন সম্পর্কে সনজীদা খাতুন লিখেছেন “আজিমপুর কলোনীতে আমার ছোট ফ্ল্যাটে ভোরবেলায় সবার ঘুম ভাঙত তার গান শুনে।...
প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন গণসঙ্গীতে, গড়লেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। শক্তি কি কেবল বন্দুকের নলে? রাজনীতিটি কেবল শ্লোগানে আর দলাদলিতে?”
১৭৫৭-র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর (১৭৫৭-র ২৩ জুন থেকে ১৭৭২), ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ঔপনিবেশিক সরকারের (১৭৭২ থেকে ১৮৫৮-র ৩১ আগস্ট) এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের (১৮৫৮-র ৩১ আগস্ট থেকে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সমাজের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ সমাজ হিসাবে শনাক্ত হওয়ার কারণে মুসলমান সমাজ সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার-বঞ্চিত হয়ে হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত হয়ে অসহায় ও অধঃপতিত হওয়ার কারণে অপরিণামদর্শী, লক্ষ্যভ্রষ্ট ও লক্ষ্যহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। এই অবস্থায় ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ, বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার-ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ ইংরেজদের সহযোগী সমাজ হিসাবে, সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাঁদের জাতীয়তাবাদের মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ সমাজ হিসাবে শনাক্ত করে স্থায়ীভাবে অধিকার-বঞ্চিত করে রাখার সিদ্ধান্ত ও দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করেছেন। ১৭৫৭-এর ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসন পরবর্তীকালের কাব্যে এবং সাহিত্যে ও মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসাবে শনাক্ত করে যে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্ত¡ আরোপকামী ইতিহাসের চর্চা হয়েছে’ এরই পরিণাম হিসাবে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখা “ভারত কলঙ্ক” নিবন্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ৪ ফেব্রæয়ারি বিকেল সাড়ে চারটায় কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে ও ভারটুন হলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ভ‚পেন্দ্রনাথ বসু, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, বিনয়েন্দ্রনাথ সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, ব্রজগোপাল নিয়োগী, হেমচন্দ্র সরকার, উপন্দ্রেনাথ বল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সারদাচরণ মিত্র, বি দে প্রভৃতি ১৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হয়ে এক জাতিতত্তে¡র এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত ও ধর্মান্তরিতদের বংশধর। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে লেখা ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে মহাত্মা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর ঠিঠিতেও সেই একই বক্তব্য আছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত ও ধর্মান্তরিতদের বংশধর, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা আলাদা কোনো জাতি নন। তাই আলাদা জাতি হিসাবে কোনো অধিকারও তাঁদের পাওনা হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশী হলো কেবল হিন্দু জাতির। হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও যদি নিজেদের আলাদা জাতি হিসাবে দাবী করেন তাহলে সেটাকে দ্বিজাতিতত্ত¡ বলে অভিহিত করে বিরোধিতা করা হবে। এটাই ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ আরোপকামী এবং তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে এর হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকামী। বক্তব্য সাতচল্লিশের মধ্য আগস্ট পূর্ববর্তীকালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সর্ব ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য ও সদাবস্থানের নীতিতে মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত, শিক্ষাগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ চেয়েছিলেন। মনুসংহিতার সমাজ ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ আরোগকামী দৃষ্টিভঙ্গিতে এর বিরোধিতা করেছিলেন।
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেউ কখনো বলেননি যে, ভারতে কেবল হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো জাতির মানুষ বাস করেন। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্্ কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নিখিল ভারত মুসলিমলীগ নেতারা সব সময়ই বলেছেন যে, ভারতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ প্রভৃতি ধর্মীয় সমাজের বা ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতির মানুষরা বসবাস করেন। জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের সবারই সমানাধিকার পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত।
\ তিন \
ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী বিশাল বিশাল বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ লেখেন যে, বাংলাভাষী মুসলমানদের সংস্কৃতি হলো “বাঙালী সংস্কৃতি”। মুসলমান ঘরের সন্তানদেরও কেউ কেউ লেখেন যে, তাদের জাতিসত্তা মুসলিম জাতিসত্তা নয়, বাঙালী জাতিসত্তা!
কিন্তু সুজিত সেন সম্পাদিত এবং ২৭ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৯, এই ঠিকানাস্থিত পুস্তক বিপণি থেকে ফেব্রæয়ারি ১৯৯১-এ প্রকাশিত ‘সাম্প্রদায়িকতা : সমস্যা ও উত্তরণ’ শীর্ষক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘মুসলমান বাঙালীর কালচার’ শিরোনামে প্রবন্ধে ১২২ পৃষ্ঠায় মননশীল লেখক গোপাল হালদার লিখেছেন :
“হিন্দু ঐতিহ্যের উপর গঠিত বাঙালী সংস্কৃতি।....
মানবতাবাদ হিন্দুত্বের কাঠামোয় বাঁধা পড়ে না।”
খুব বেশী কৌশলী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামী সংস্কৃতি এবং মুসলিম সংস্কৃতিকে অভিহিত করেন পাকিস্তানী সংস্কৃতি বলে। সমাজহীন মুসলমান সমাজের প্রচÐ ক্ষমতাবান এবং বিশাল প্রভাবশালী লোকজনদের কেউ কেউ এমন অতিরিক্ত কৌশলী ও কুটবুদ্ধিসম্পন্ন অন্যায়কারী হলে সমাজ থেকে সততা ও মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায় এবং অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভারতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সী, ইহুদী, শিখ, প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের মানুষ বাস করেন। তাই ভরতের সংস্কৃতি বোঝাতে কেবল হিন্দু সংস্কৃতি বোঝানোটা অন্যায়। অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি পাকিস্তানী সংস্কৃতি বলতে কেবলমাত্র মুসলিম সংস্কৃতিটা বোঝানোটা অন্যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে দেখতে হবে ইসলামী সংস্কৃতিকে এবং মুসলিম সংস্কৃতিকে।
কিন্তু ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট যে পাকিস্তান মুসলিম প্রধান অভিবক্ত বাংলা, মুসলিম প্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাব এবং মুসলিম প্রধান অবিভক্ত আসাম বিভাজনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গা দিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশ জায়গা দিয়ে অত্যন্ত সাময়িকভাবে সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশে এমন মুসলিম প্রধান দেশ। এর পর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদেরকে আলাদা কোনো জাতি হিসাবে স্বীকার না করার একতরফা শর্তে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের সমাজপতিদের নেতাদের ঐতিহাসিকদের এবং বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্টভাবেই উপলদ্ধি করা যায় যে, ১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টে অত্যন্ত সাময়িকভাবে সৃষ্ট মুসলিশ প্রধান রাষ্ট্রটি বিধ্বস্ত হয়ে কোনো এক সময়ে আবার হিন্দু সমাজ প্রধান ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে সেটাই হলো তাদের অপ্রতিরোধ্য এবং আপোষহীন আকাক্সক্ষা।
বিষয়টিকে যদি কেউ তাত্তি¡ক দিয়ে গভীরভাবে খতিয়ে দেখেন তা হলে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চা আমরা যেভাবে মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সেই পাকিস্তান আমলেই দাঁড় করিয়েছি তা তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এক হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েমের পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যেমন ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত খোদ পাকিস্তান আমলেই খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসের পাঠ্য তালিকার দিকে নজর দিই তা হলে লক্ষ্য করা যাবে যে, সেখানে কেবল মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতিক পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য বাদ দিয়ে বেকল হিন্দু সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত অবশ্য পাঠ করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং বৈষ্ণব পদাবলীও অবশ্য পাঠ করা হয়েছে। কিন্তু বিশাল নজরুল সাহিত্য ও সঙ্গীতের কোনো কিছুই অবশ্য পাঠ করা হয়নি। কোনো কোনো সংগঠন এবং সম্পদের জায়গা থেকে সেই পাকিস্তান আমলেই কোনো সামাজিক শক্তির তরফে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে যে, মুসলিম প্রধান দেশের মুসলমানদের মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তাদের হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা মুসলমানদের নিজেদের বলে গ্রহণ করাতে হবে। এই একই লক্ষ্যে কেউ কেউ বলেন যে, মুসলিম প্রধান এলাকায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটা পরিণাম হিসাবে যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে সেই রাষ্ট্রে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এবং ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার কোনো ঠাঁই থাকতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ তারিখে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডের ‘দেশ’ পত্রিকায় “মায়াবিনী ঈশ্বরীর দেশ ভারতই ‘দ্য কন্টিনেন্ট অব সার্সি’র অন্তর্বস্তু/অনাবাসী ভারতপথিক নীরদচন্দ্র” শীর্ষক নিবন্ধে অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন:
“অধ্যাপক জে.আর. গ্রিনের একটা মন্তব্য স্মরণে আসছে, বাংলা তর্জমায় তা এই প্রকার রাষ্ট্র তো একটা আকস্মিক ঘটনা, সেটা গঠন করাও যেতে পারে আবার ভেঙেও দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু এটা জাতি হল সত্য পদার্থ যা ইচ্ছে করলেই গঠন করা যায় না অথবা ধ্বংস করা যায় না।”
\ চার \
মুসলমান ঘরের কোনো কোনো সন্তান ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে আসছেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডের ২ অক্টোবর ২০১৫ তারিখের “দেশ” পত্রিকায় দেখছি, আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলায় পি.ও. বিল্ডিংস নিকলসন রোড, দিল্লী এই ঠিকানা থেকে ১ আগস্ট ১৯৬৬ তারিখে নীরদচন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) ৯০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :
আমরা, হিন্দুরা জন্মসূত্রে ও মৌলিক সত্তায় (যদি আমরা তার দ্বারা চালিত হই) ইউরোপীয়। আপনি যদি বলেন যে, আপনি হিন্দুও নন, মুসলিমও নন তা হলে তার মানে দাঁড়ায়, আপনি এক মনুষ্যরূপী প্লাস্টিক বেলুন যা ভারতে নির্বোধেরা থাকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ বলে, সেই ধর্ম নিরপেক্ষতার নাইট্রজেনে ভরতি।”
রাষ্ট্রের আদর্শ হওয়া উচিত সব জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সাম্য এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতি, আইনগত, শিক্ষাগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থান। আর ধর্ম নিরপেক্ষতার কোনো প্রয়োজন নেই এই কারণে যে, পৃথিবীর কোনো ধর্ম গ্রন্থেই অন্য ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে কোথাও কিছু নেই। ধর্ম নিয়ে জাতীয়তাবাদ দাঁড় করালে তখন অবশ্য সমস্যা হয়। বর্ণ বা গায়ের রঙ, ভাষা এবং অঞ্চল বা আঞ্চলিকতা নিয়ে জাতীয়তাবাদ দাঁড় করালেওতো অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার হরণ করা হয়।
তৌহীদবাদকেন্দ্রিক বা আল্লাহর একত্ববাদকেন্দ্রিক, আল্লাহর ওয়াননেশকেন্দ্রিক ইসলাম কোনো রকম জাতীয়তাবাদ অনুমোদন করে কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ করে সাম্প্রদায়িক হওয়া শেখায় না। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো জনগোষ্ঠীর জান-মাল কেড়ে নিয়ে ফ্যাসিস্ট হওয়ার অনুমোদন তো ইসলাম দেয়ই না। অন্য কোনো ধর্মও অবশ্য এটা দেয় কিনা সেটা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। তবে দেখা যায় যে, ইহুদী, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ এই সব ধর্ম নিয়ে কোনো কোনো সময় কোনো কোনো দেশে কিছু লোক জাতীয়তাবাদী হয়ে মুসলমানদের অধিকার হরণ করেছেন, মুসলমানদের জানমাল কেড়ে নিয়েছেন। এটা তাদের ধর্মও অনুমোদন করে না। ধর্ম নিয়ে জাতীয়তাবাদ দাঁড় করানোর ফলে এটা হচ্ছে। সাংস্কৃতিক সমস্যা দূর করতে হবে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে। কোনো ধর্মীয় সমাজে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে প্ররোচনা সৃষ্টি করাটা গর্হিত অন্যায় কাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন