শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলা নববর্ষ সংখ্যা

নববর্ষের কামনা

| প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এমাজউদ্দীন আহমদ
বাংলা নববর্ষের এই শুভ মুহূর্তে এ জাতি আশা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রটি শস্য শ্যামল হয়ে উঠুক। প্রাণবন্ত হোক। হয়ে উঠুক ফল প্রসবিনী। বিদ্যমান সকল ধূলিকণা বৈশাখের ঝড়ে উড়ে যাক। আক্রোশ, প্রতিহিংসা এবং জিঘাংসার উদ্যত ফণা অবনত হোক। সহনশীলতা, সহযোগিতা এবং রুচিশীলতার সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত হোক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্রটুকু। গণতন্ত্রের প্রত্যাশিত সাফল্য জনগণের জীবনকে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান করে তুলুক।
গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি হলো জনকল্যাণকর এক জাতীয় উদ্যোগ। সৃজনশীল এক কর্মপ্রবাহ। তাই রাজনৈতিক কর্মকাÐ বর্তমানকে ঘিরে রচনা করে তার কর্মক্ষেত্র। ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অগ্রগতির মহাসড়ক নির্মাণে উদ্যোগী হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি কিন্তু জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করার পরিবর্তে রূপান্তরিত হয়েছে প্রতিহিংসার এক উত্তপ্ত শক্তিশালী মাধ্যমে। বর্তমান ও ভবিষ্যতকে এড়িয়ে তাই রাজনীতি হয়ে উঠেছে অতীতমুখী। জীবনঘনিষ্ঠ না হয়ে হয়েছে নেতাসর্বস্ব। অতীতে নেতা কী বলেছেন, কী করেছেন, কোন স্বপ্ন দেখেছেন তাই যেন সরকারের আলোচ্যসূচি। নেতাকে সরকারি সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন, বিরোধী দলের নেতার ওপর দোষ আরোপই সরকারের প্রধান কর্মসূচি। অন্য সব আনুষঙ্গিক অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত সমাজ জীবনের প্রতি নিরাসক্ত থেকে সরকার ব্যস্ত শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের মায়া-মমতাহীন প্রক্রিয়ায়।
গণতান্ত্রিক সমাজে সকল গ্রæপ ও দলের মধ্যে রাজনীতি ঐক্যের সেতুবন্ধন রচনা করে অনৈক্যের মধ্যে ঐক্যের সুর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে রাজনীতি কিন্তু হয়ে উঠেছে বিভেদ, বিভাজন এবং অনৈক্যের অন্ধ গলি। ফলে সমাজ হয়েছে বিভক্ত। কোনো আদর্শের ভিত্তিতে নয়, নয় কোনো কর্মসূচির ভিত্তিতে। বিভক্ত হয়েছে শুধুমাত্র ক্ষমতা প্রয়োগকে কেন্দ্র করে। ক্ষমতার কাছাকাছি যারা তারাই যেন সরকারের, রাষ্ট্রের, প্রতিপক্ষ বিরোধী দল বা ভিন্ন মতের অনুসারীরা শত্রæ শিবিরের। তারা অবাঞ্ছিত। নির্যাতনই তাদের প্রাপ্য। নিপীড়নই তাদের জন্য। অন্য কিছু নয়। ফলে নীতির ভিত্তিতে এবং ক্ষমতা প্রয়োগকে কেন্দ্র করে যে বিভক্তি সরকারের নিকট তা স্থায়ী এবং এই স্থায়ী বিভক্তিকে নিয়েই সরকার অগ্রসর হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি বিতর্কের অবসান ঘটায়। বাংলাদেশের রাজনীতি কিন্তু সৃষ্টি করে চলেছে নিত্য নব নব ক্ষেত্রে অসংখ্য বিতর্ক। জাতীয় আদর্শ সম্পর্কে বিতর্ক, জাতীয় নেতা সম্পর্কে বিতর্ক, এমনকি জাতিসত্তার মৌল বৈশিষ্ট্য এবং ভিত্তি সম্পর্কেও বিতর্ক। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের বিতর্কে জনসমষ্টি বিভক্ত। জাতিসত্তার ভিত্তি সম্পর্কিত বিতর্কে জাতি বিভক্ত। ২৬ মার্চে প্রতিষ্ঠিত ‘শিখা চিরন্তনের’ বিতর্কে নতুন সূত্র সংযোজিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে অর্জিত বিজয় জনগণের। নয় কোনো নেতার, নয় কোনো দলের। এমনকি সরকারও সে বিজয় জনগণের বিজয় বলে চিহ্নিত করে, কেননা গণতন্ত্রে সরকার জনগণকে আস্থায় নিয়েই কর্মপন্থা নির্দিষ্ট করে। জনগণকে আস্থায় নিয়েই সরকার অগ্রসর হয় জটিল জাতীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, সঙ্গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। নীরবে নয়, সরবে। জনপ্রতিনিধিদের সাথে তর্ক-বিতর্কের পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিন্তু জনগণ আজ গৌণ। মুখ্য হলো সরকার এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। বাংলাদেশে জনগণ এবং জনগণের সার্বিক স্বার্থ আজ উপেক্ষিত, বিপন্ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনত মান জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের মতো নিত্য ব্যবহার্য উপাদানের সঙ্কট একদিকে যেমন কৃষি শিল্পের অগ্রগতির পথ করছে রুদ্ধ, অন্যদিকে জাতীয় জীবনে টেনে আনছে অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকার। নারী নির্যাতনের মাত্রা অবিশ্বাস্যরূপে উচ্চ।
দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের দুর্বিনীত প্রক্রিয়া রুচিশীলতার সকল প্রক্রিয়া ছাড়িয়ে গেছে। সরকার কিন্তু প্রতি মুহূর্তে ব্যস্ত রয়েছে অতীত ইতিহাসের ছেঁড়া পাতায় দৃষ্টি দিয়ে, অস্বচ্ছ পৃষ্ঠাগুলোকে আলোকোজ্জ্বল করার লক্ষ্যে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। ভারতের সাথে ৩০ বছরের গঙ্গার পানি বণ্টনের এক চুক্তি হলো বটে, কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তা বানচাল হবার উপক্রম। পানি এলো না। ক’দিন আগের হিসেবে, চুক্তি করার পূর্বে যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশ পেয়েছে চুক্তির পর তাও মিলছে না। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন মূলধন, বাজারের স্থিতিশীলতা এবং জনগণের সার্বিক আস্থা। কিন্তু শেয়ারবাজারে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয় এবং তার সাথে সরকারি দলের বড় বড় সমর্থকের সংশ্লিষ্টতার যে চিত্র জাতির সামনে উঠে আসে, তা বিদেশী বিনিয়োগকারী কেন দেশী বিনিয়োগকারীদেরও করেছে আতঙ্কিত।
আট জাতির দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) কার্যক্রমকে এড়িয়ে গিয়ে নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়ন চতুর্ভুজের চালচিত্র যেভাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকা সম্পর্কে সকলকে তা সন্দিহান করে তুলছে। দেশের অভ্যন্তরে পরিবহনের জটিলতা নিরসনের পরিবর্তে প্রতিবেশী ভারতকে তার এক স্থান থেকে অন্য অংশে সহজে পরিবহনের সুবিধা দানের লক্ষ্যে যে ট্রানজিট সুবিধার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা সমগ্র জনসমষ্টির মধ্যে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবে সরকার ভারতকে যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে তা অত্যন্ত মারাত্মক। একজন ইংরেজ চিকিৎসকের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে মোগল স¤্রাট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্য করার যে সনদ দান করেন এও অনেকটা তাই। এবং এই সবকিছুই ঘটছে জাতীয় সংসদে কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই, যদিও এ সরকার বারবার ঘোষণা করেছে, জাতীয় সংসদই হবে রাজনৈতিক কর্মকাÐের কেন্দ্রবিন্দু। সরকার তার স্বরে বলে চলেছেন, জনগণই হলো সকল ক্ষমতার উৎস।
নতুন বছরে নতুন আশায় সবাই বুক বাঁধে। চৈত্রের দাবদাহের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে যেমন বৈশাখের প্রচÐ বেগ শুধু সব আবর্জনা উড়িয়ে দেয় না, ঝড়ের পর প্রশান্তির বারিধারায় ভূমি শীতল হয়। জীবন পায় নতুন আশ্বাস। নতুন প্রত্যয়। বাংলাদেশে আমরাও সে আশায় বুক বেঁধেছি। গণতন্ত্রের অনাবিল পরিবেশে রাজনৈতিক কর্মকাÐ পরিচালিত হোক। জাতীয় অগ্রগতির নতুন ধারা সূচিত হোক। আগেই বলেছি, জাতীয় বিভক্তি জাতীয় অগ্রগতির জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধক। নতুন নতুন বিতর্ক জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য বড় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বিভেদ এবং অনৈক্য অনাকাক্সিক্ষত। সরকার আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু রাষ্ট্র রয়েছে। রয়েছে জাতি। রয়েছে সমাজ। আজকেও সরকার যা করবে তাই আগামী দিনে নতুন সরকারের কর্ম উদ্যোগের ভিত্তি হবে। এভাবে ধারাবাহিকতার এক স্বর্ণসূত্রে জাতীয় কর্মপ্রবাহ আবদ্ধ থাকবে। নতুন বছরের শুরুতে আমরা আশা করি, প্রতিহিংসা আর নয়, সহনশীলতাই হোক নতুন পথের সঙ্গী। সংগ্রাম আর নয়, সহযোগিতাই হোক নতুন দিনের নতুন সুর। বিভেদ আর নয়, ঐক্যই হোক আগামী দিনের উচ্চারণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন