ম. মীজানুর রহমান
বিশ্বব্যাপী মানব সম্প্রদায় সর্বত্র আপন আপন অস্তিত্ব রক্ষায় জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ। আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না এসবই মানুষকে সতত সইতে হয় এ জীবন সংগ্রামে। সকল বৈরী এবং প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকাও মানুষের জীবন অন্তর্গত স্বভাব। এইসব আশা-নৈরাশ্য, শুভ-অশুভ তথা সময়ের বিভ্রান্তিকর সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানুষ চায় একটা শুভ দিনের সূচনা। সেটা এমন একটা দিন যেদিন থেকে অনন্তকালের কাছে সকল মানুষের একই প্রার্থনা হয়ে দাঁড়ায় যে, আগামী দিনগুলো যেন শুভ হয়ে সুন্দর হয়ে কেটে যায়। আর সেই একটি দিন হচ্ছে বছরের প্রথম দিন।
বাঙালি তার আপন দেশ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই শুভদিনটি পালন করে থাকে। কোনো কোনো সময় এ মাসটির প্রায় প্রথম থেকেই শুরু হয় কালবৈশাখীর ঝড় তথা প্রচÐ ঘূর্ণিঝড়ের তাÐবলীলা। আর তা দেশের কোখাও কোথাও বয়ে আনে মহা দুর্যোগ। নৈসর্গিক ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বছরে বছরে কত মানুষ যে হতাহত হয়, কত ঘরবাড়ি যে বিধ্বস্ত হয়, কত মানুষ যে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তার কে হিসাব রাখে জানি না, বাংলাদেশি জনগণ তবু যে দুর্জয় সংকল্পে এ সকল বৈরী প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতার সঙ্গে লড়াই করে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে চলেছে যুগ যুগ ধরে তা সত্যিই বড় বিস্ময়ের বিষয়।
শুভ নববর্ষ থেকে সকলেই কামনা করে আপন আপন ভাগ্যের পরিবর্তন। নতুন কর্ম, নতুন প্রত্যাশা আর নতুন উদ্দীপনায় নতুন জীবনের উৎকর্ষতা নিয়ে সহসা যেন বাঙালি-মানস উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং নববর্ষের সূচনায় জেগে ওঠে নতুন নতুন স্বপ্ন আর তা বাস্তবায়নের প্রদীপ্ত দীশায় হয়ে ওঠে সবাই উৎফুল্ল। তাই বাঙালির ঘরে ঘরে আসে ঐদিন উল্লসিত উৎসবমুখরতা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হিসাব নিকাশ হালখাতা প্রণয়ন, দোকানে দোকানে ক্রেতাসাধারণের বকেয়া পরিশোধকল্পে ক্রেতা সাধারণের বাড়ি বাড়ি চৈত্র মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নানা বাহারি রংয়ের কার্ড শৈল্পিক নৈপুণ্যে লেখা আমন্ত্রণপত্র দেয়া শুরু করেন ব্যবসায়ী মহাজনেরা। পহেলা বৈশাখের দিন হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ক্রেতাদের মাঝে মিষ্টান্ন বিতরণ করে ব্যবসায়ী মহাজনগণ প্রকাশ করেন পরম সহৃদয়তাভরা প্রীতি ও শুভেচ্ছা। বাঙালিদের মতন ক্রেতাদের ধরে রাখার এমন হৃদ্যতাপূর্ণ মহাজনী কারবার পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এটা আবহমানকালের বাঙালি ব্যবসায়ীদের খরিদ্দার আপ্যায়নের রুচিশীল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এক মোহনায একত্রে আপ্যায়নের এ দৃষ্টান্তেই প্রমাণিত বাঙালি মানসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র তথা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সমন্বিত স্বার্থ পরম্পরায় এই উৎসবমুখর সামাজিকতা এবং নান্দনিক পরিবেশ বড়ই সুখকর ও মনোমুগ্ধকর। এমন সম্বুদ্ধি সঞ্জাত মানসিকতা যদি বাঙালিদের সকলের জীবনে প্রতিদিন প্রতিফলিত হতো তাহলে বাংলাদেশ হতো বিশ্বের এক অনন্য অনুকরণযোগ্য দেশ। সকল সম্প্রদায় সম্প্রীতির আর সহৃদয়তার এই সত্য সুন্দরের চিত্রটি কেবল পহেলা বৈশাখেই মেলে। এ অনুভ‚তি অনির্বচনীয়।
সমগ্র দিবসের উৎসবমুখরতা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং ভিন্ন ভিন্ন লোকাচার সম্পৃক্ত অনুষ্ঠানাদি এরই সঙ্গে থাকে সক্রিয়। সাংকৃতিক অনষ্ঠানাদির মধ্যে উল্লেখয়োগ্য হচ্ছে ঋতুভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠান, লোকনৃত্য, লোকসঙ্গীত, বিভিন্ন রকমারি কুঠির শিল্প-মেলা, পুতুলনাচ, সার্কাস, কৃষিজাত পণ্যের প্রদর্শনী, কারুশিল্প, হস্তশিল্প, মৃতশিল্পের সমাহারে দর্শনীয় বিপণি সামগ্রীর বিকিকিনি, নববর্ষ সম্পৃক্ত সাহিত্য আলোচনা, কবি-সাহিত্যিক সমাবেশ, কবিতা আবৃত্তি, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, মসজিদে, মঠে, মন্দিরে, গির্জায় উপসনাকালে আগামী দিনগুলো যাতে শুভ হয়, শান্তিময় হয়, মানুষের জীবন যাতে সুখ-সমৃদ্ধি তথা বৈষয়িক প্রাচুর্যে উন্নততর হয় সেই লক্ষ্যে পরম করুণাময় সর্বসৃষ্টিকর্তার সদয় আনুক‚ল্য পাওয়ার জন্য আকুল প্রার্থনা জানানো।
বাংলা সনের প্রবর্তন
বাংলা সন সঠিক কবে প্রবর্তিত হয়েছিল সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক কোন তথ্য মেলে না। তবে মোগল স¤্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) রাজস্ব সচিব টোডরমলকে স¤্রাট নির্দেশ দেন সমগ্র বিজিত এলাকা জরিপ করে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। বৈশাখ মাস তখন বাংলাদেশের ফসলি মাস। তাই স¤্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন বৈশাখের পহেলা থেকেই বিবেচনা করেন। সে নিরিখে মোগল স¤্রাট আকবর-ই হলেন বাংলা সনের প্রথম প্রবর্তক। সে সময় রাজস্ব আহরণ করা হত প্রজাদের সুবিধানুযায়ী পরিমাণমত শস্য প্রদান করে অথবা নগদ মুদ্রায়। রাজস্ব কর এভাবেই সংগ্রহ করার রাজকীয় নির্দেশ ছিল। এবং স¤্রাটের কড়া নির্দ্দেশ ছিল, বলপূর্বক কিংবা কোনরূপ নির্যাতন চালিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করা যাবে না। প্রজারা তাদের সুযোগ ও সুবিধানুযায়ী স¤্রাটীয় কোষাগারে কর জমা দিতে পারবেন।
আবুল ফজল আল্লামী প্রণীত আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে এই তথ্য মেলে। এছাড়া বাংলা বা ভারতের ইতিহাসে বাংলা তারিখ সন সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য লিপিবদ্ধ নেই। এখানে উল্লেখ্য যে আইন-ই-আকবরী অত্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ।
কথিত আছে বাংলার জমিদারেরা পহেলা বৈশাখের নববর্ষের উৎসবটি জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করতেন ‘পুণ্যাহ’ নামে। ঐদিন প্রজাদের জমিদারদের পাওনা খাজনাসমূহ মিটিয়ে দিতে হত। প্রজাদের উপর ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের অত্যাচার-অবিচারের কাহিনী বাংলার মানুষের কারুর কাছে আজ আর অবিদিত নেই। সুতরাং ‘পুণ্যাহ’ যে খাজনা আদায়ের কড়া কৌশলী ব্যবস্থা এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এটাতে জমিদারদের এক ধরনের প্রজা পীড়নের ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই ছিল ন। সুতরাং পুণ্যাহকে সার্বজনীন উৎসব বলে অভিহিত করা চলে না।
উল্লেখ্য, আকবরের রাজত্বকাল থেকে অদ্যাবধি কত যুগ কত কাল অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু বাঙালির নববর্ষ পহেলা বৈশাখ এবং তার ঐতিহ্যিক বৈভব অভিন্ন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবর্তে রয়ে গেল অক্ষুণœ বরং প্রথাগত নানান নন্দিত উৎসব আয়োজনায়। দিবসটির তাৎপর্য প্রসারিত হল আধুনিকতার দীপ্তিময়তায়। অন্তর্নিহিত বেদনায় জনজীবনে এমন এক দিনের অনাবিল আনন্দের সমারোহ সত্যিই বড় অমূল্য, বড় তাৎপর্যময়।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কলাম লেখক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন