শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মাওলানা কোরবত আহমদ রহ.

| প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নক্ষত্রের জীবনাবসান
মুহাম্মদ কামাল হোসেন : যে সকল খ্যাতিমান মনীষী তাদের অমূল্য কাজ-কর্মে, ইলমে-আমলে ও তাকওয়ায় চিরস্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন, এদের মধ্যে বৃহত্তর দক্ষিণ কুমিল্লার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন হযরত মাও. কোরবত আহমদ (রহ.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৩৪ সালের কোনো এক আলো ঝলমল প্রভাতে নিজ আবাসস্থল রহমতপুর (চেঙ্গাহাটায়) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম মো. রহমত আলী মুন্সী। যিনি তৎকালীন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সন্তানদের মধ্যে মাও. কোরবত আহমদ ছিলেন প্রখর বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন মেধাবী ও সৎ চরিত্রবান। শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির। পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরা যখন খেলাধুলায় বিভোর থাকত, তখন তিনি ব্যস্ত থাকতেন অধ্যয়নে। মাঝে মধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে একাকী ভাবনা-চিন্তায় মত্ত থাকতেন। মূলত পিতার নিকট তাঁর শিক্ষ জীবনের শুরু। ছোটশরীফপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মৌকরা দারুস সুন্নাত মাদরাসায় ভর্তি হন। মৌকরা শিক্ষাজীবনেই তাঁর পরবর্তী জীবন গঠনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখে। মাও. কোরবত আহমদ সাহেবের প্রখর মেধা, আমল, তাকওয়া ও বুজর্গী দেখে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পীরে কামেল জনাব আলহাজ শাহ ওয়ালী উল্লাহ তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন ও বিশেষ নজরে রাখতেন। মৌকরার শিক্ষাজীবন কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করে ছারছীনা মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কামিল পরীক্ষায়ও অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন।
মাও. কোরবত আহমদ (রহ.) এক সময়ের বিদ্যাপীঠ মৌকরা মাদরাসায় শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর পড়াবার কৌশল, ছাত্রদের প্রতি তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ এবং দরদ-মমত্ববোধ সর্বোপরি তাঁর ইলম ও পরহেজগারির কারণে মৌকরায় কিছুদিনের মধ্যে তিনি খুব মসহুর হয়ে গেলেন। পাশাপাশি তাঁর বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকমÐলী ও ছাত্রদের মধ্যেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তাঁর সুখ্যাতি আমল আখলাক ও তাকওয়া দেখে জনাব শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.) তাঁর জৈষ্ঠ কন্যাকে মাও. কোরবত আহমদ (রহ.) সাথে বিয়ে দেন। মৌকরা মাদরাসায় অনেক বছর শিক্ষকতার পর কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চিওড়া মাদরাসায় সুদীর্ঘ ৭/৮ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর হঠাৎ করে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে একদিন নিজ জন্মস্থানে ফিরে আসেন এবং নিজবাড়ি সংলগ্ন রহমতপুর (চেঙ্গাহাটা) গ্রামে রাসূল (সা.) দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) নামানুসারে ১৯৬৯ সালে “জামেয়া ইসলামীয়া হোসাইনিয়া রহমতপুর চেঙ্গাহাটা মাদরাসা” প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি তিনি অত্র মাদরাসার মোহতামিম হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে তিনি বহু মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, ঈদগাহ ও বিভিন্ন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সুদীর্ঘকাল ইমাম ও খতিব ছিলেন ঐতিহ্যবাহী ভুশ্চিবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের। মাও. কোরবত আহমদ (রহ.) ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, মিষ্টভাষী, নম্র ও সদালাপী সজ্জন ছিলেন। মানুষ হিসেবে তিনি সহজ-সরল ও নম্র প্রকৃতির হলেও, পাশাপাশি তিনি ছিলেন অটল অবিচল ও ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কোনো প্রকার জাগতিক লোভ, লালসা, প্রলোভন কিংবা ক্ষমতার মোহ তাঁকে দ্বীন ইসলামের বিধি বিধান তথা অনুশাসন থেকে একবিন্দুও টলাতে পারেনি। যেখানে অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই তড়িৎ বেগে ছুটে গিয়ে প্রতিরোধ করেছেন। হাতে রাখা লাঠি দিয়ে দমন করেছেন সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতনের। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন সমাজে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টিকারী বিধ্বংসী কর্মকাÐ করার দুঃসাহস কেউ কখনো ঘূর্ণাক্ষরেও দেখাতে পারেনি। তিনি বজ্রমুষ্টিতে অন্যায়ের টুটি ছেপে ধরেছেন। অশ্লীল গান-বাজনা, মদ-জুয়া, থেকে শুরু করে কোনো অন্যায় অপরাধকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। দ্বীনি প্রয়োজনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি চষে বেড়িয়েছেন,
বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন রঙের মানুষের সাথে উঠবস করেছেন, কখনো অসাবধানতায় বা বেখেয়ালের বশেও কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। জিকির, আসকার ও বিভিন্ন মাসনুন দোয়া-দুরুদে সময়কে কাজে লাগিয়েছেন। রিয়াকে যমের মতো ভয় পেতেন বলে এই মহান মানুষটি মিডিয়া ও অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগেও প্রচারবিমুখ ছিলেন। আল্লাহ তাআলার রাজিখুশির নিমিত্তে সদা বিভোর থাকতেন।
এই মহান ব্যক্তিত্ব ২০০৫ সালের ২৮ জুন এক নিরানন্দ প্রকৃতির বর্ষণমুখর দিনে মহাপরাক্রমশালী মহান সৃষ্টিকর্তার অপার সান্নিধ্যে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পাড়ি জমান। দক্ষিণ কুমিল্লার এই বিশিষ্ট আলেমেদ্বীনের মৃত্যুতে নিমেষে সর্বত্র শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। মেঘ বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে তাঁর জানাযায় দেশের শীর্ষ স্থানীয় বহু আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ উপস্থিত হন। এছাড়া পিপীলিকার ন্যায় লাখো সাধারণ মানুষের ঢল নেমে আসে। মানুষের আল্লাহ আল্লাহ উচ্চধ্বনি, কান্না ও রোনাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় তাঁর মৃত্যুতে প্রকৃত আলেমেদ্বীনের যে শূন্য স্থান সৃষ্টি হয়েছে, তা সত্যিই অপূরণীয়। আজো মানুষ ব্যাথাতুর হৃদয়ে তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে। তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে করা হয়েছে ‘মাও. কোরবত আহমদ (রহ.) ফাউন্ডেশন’ ও ‘মাও. কোরবত আহমদ (রহ.) সড়ক’। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও ভক্তবৃন্দ রেখে গেছেন। দোয়া করি মহান আল্লাহ তায়া’লা যেন তাঁকে জান্নাতের উৎকৃষ্ট উচ্চ মকাম দান করেন।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন