আফজাল বারী : আসন্ন ইউনিয়র পরিষদ নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে শেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা। অব্যাহত, হুমকি, হামলা, গুলি, ভাংচুর, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, মারপিটে রক্তের দাগ না শুকাতেই গতকাল নতুন কৌশল প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। প্রার্থীকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কোথাও কোথাও জোরপূর্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য স্বাক্ষর নেয়া হয়। কোথাও ‘এরশাদীয় কায়দায় প্রার্থীকে অসুস্থ বানানো হয়েছে। এ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন শুধু বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরাই নন, তাদের পরিবারের সদস্যরাও। ইতোমধ্যে অনেকেই ঘরবাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বা নির্বাচন কমিশনের আবেদ-নিবেদন বা অভিযোগ করে কোন ফল মিলেনি। বরং উল্টো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আলাপকালে প্রার্থীরা জানিয়েছেন, দলীয় মনোনয়ন এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে অনেকেই প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছে।
এদিকে নির্বাচনের ফলাফল কি হবে- আগেই তা বুঝতে পেরেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান গতকাল নির্বাচন কমিশনে বৈঠক শেষে বলেছেন, পৌরসভার মতো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে বিজয় ছিনিয়ে নেবে সরকারি দল। তারা ৭০০ নিজে নেবে এবং ২০/৩০টি বিএনপিকে দেবে। তবে আওয়ামী লীগ এ চিত্রকে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাহিসেবে আখ্যা দিয়েছে। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপি মনোনয়ন দেয়ার সময় তাদের প্রার্থী খুঁজে পায়নি। এখন মনোনীত প্রার্থীরা জেনে গেছে তারা হেরে যাবে- তাই আগেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করছে।
প্রথম ধাপের ৭৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হবে আগামী ২২ মার্চ। মনোনয়নপত্র জমা দানে বাধা, প্রার্থী না পাওয়ার কারণে প্রথম ধাপে ১১৪ টি ইউপিতে ধানের শীষের কোনো প্রার্থী ছিলো না। বাগের হাটের ৭১ ইউনিয়নের মধ্যে ৩৪টিতে বিএনপির কোন প্রার্থীই নেই। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। যারা দাখিল করেছিলো গতকাল তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক স্থানে নির্যাতনের শিকার প্রার্থীরা বিএনপির কেন্দ্র বা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সাথে যোগাযোগও করছেন না। বিকাল ৫টা পর্যন্ত এসব প্রার্থী ও তাদের দোসরদেও মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। আবার অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও প্রচারণা চালান। যেসব ইউপিতে বিএনপির মূল প্রার্থীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হয় সেগুলো হলো- বরিশালের বানারীপাড়ার উদয়কাঠি ইউপির কাঞ্চন তালুকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর উপজেলার পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়ন এসএম দেলোয়ার হোসেন, ছয়ফুল্লাকান্দিতে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মো. শাহজাহান মিয়া। শিবচরে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক বাতিল হওয়া মনোনয়ন পত্র বৈধ হওয়া সত্ত্বেও দত্তপাড়া ইউনিয়নে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানুর রহমান তালুকদার, সাতক্ষীরায় বিএনপির প্রার্থী কাদামাটি ইউপির মো: জহির, বুড়িগোয়ালিনি ইউপির শফিকুল ইসলাম, ভোলার দৌলতখান উপজেলার চর খলিফা ইউনিয়নে ধানের শীষ প্রার্থী হারুন অর রশিদ, কাশিমারিতে আজিজুর রহমান সরদার, ভরুলিয়ায় মতিন গাজী। বরকামতা ইউনিয়নে বিএনপি’র দলীয় প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ হারুন অর রশিদ।
বরিশাল : বরিশালে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে ৩৮জন চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থীর চাপে পড়ে অধিকাংশ প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। এমনকি বর্তমান চেয়ারম্যান এবং বিএনপি’র মনোনিত প্রার্থীও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
পিরোজপুর : জেলার ৩৯টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ২৮ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ১৫, বিএনপির ৪ ও স্বতন্ত্র ৯ জন।
মাদারীপুর : জেলার শিবচরের ১ম ধাপের নির্বাচনে ১৬ ইউনিয়নের মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে বিএনপি প্রার্থীসহ ৫জন চেয়ারম্যান প্রার্থী, ১৫ জন সদস্যের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে আজ বিএনপি প্রার্থীসহ ৫ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। এ কারণে উপজেলা ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ১২টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ের পথে রয়েছেন। এর মধ্যে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক বাতিল হওয়া মনোনয়নপত্র জেলা রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক বৈধ হওয়া সত্ত্বেও গতকাল বুধবার ৩ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া : বি.বাড়িয়ায় বিএনপির মূল ২ প্রার্থীসহ ৬ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। এদিকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার প্রসঙ্গে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এমএ খালেক বলেন, ‘আমাদের ২ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে আওয়ামী লীগের লোকজন বাধ্য করেছে। তাই তারা ওরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে জোর করে প্রত্যাহার করা মোটেও ঠিক হয়নি।’এ বিষয়ে পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নের বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী এস এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকজন আমাকে মামলা হামলা দিয়ে ফাসানোর ভয়ভীতি দেখানোর কারণে আমি মনোনয়নপত্র তুলে নিয়েছি।
ভোলা : ভোলার ৭ উপজেলায় গতকাল বুধবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে শেষ সময় পর্যন্ত কাল ক্ষেপন করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বিকাল ৫ টা পর্যন্ত এসব প্রার্থী ও তাদের দোসরদেও মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। আবার অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও প্রচারণা চালান। ফলে রাখব বোয়ালরা কেউ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। আবার দৌলতখান উপজেলার চর খলিফা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি দলীয় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হারুন অর রশিদ মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও রহস্য বিরাজ করছে । হারুন অর রশিদেও মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্ম গোপনে থাকেন। ফলে ওই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান মুকু একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়লাভ করতে যাচ্ছেন।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালীতে ১৭ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রত্যাহার করেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ১৩ ও বিএনপির ৪ জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। ময়মনসিংহ : ফুলপুরে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৯ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়নের নির্বাচনে ৫ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ইলিয়াছ কাঞ্চন চৌধুরী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। শেরপুর : মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এক ও বিএনপির দুই বিদ্রোহিসহ চার চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। রংপুর : রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ১নং কল্যানী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২২ মার্চ প্রথম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত চেয়ারম্যান পদে ৪ জন প্রত্যাহার করেন। কুমিল্লা : দেবিদ্বারে বিএনপি জাপা’সহ ৫ চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। এরমধ্যে বরকামতা ইউনিয়নে বিএনপি’র দলীয় প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ হারুন অর রশিদও আছেন। বগুড়া : জেলার ১৩ ইউপিতে ৬ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ার মিরপুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ৩৬ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৪ জন বিএনপির ১ জন ও স্বতন্ত্র ৫ জন। পাবনা : ৯ ইউপিতে মোট ১০ জন প্রত্যাহার করেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৫ ও স্বতন্ত্র ৫ জন। নেত্রকোনা: নেত্রকোনায় কোন প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন