মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার

| প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

\ এক \
ইসলাম শ্রম ও শ্রমিকের অধিকারকে সমানভাবে মর্যাদা প্রদান করেছে। পৃথিবীর কোথাও শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে মানুষের কোনোই সচেতনতা ছিল না। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদীনার নগর রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ইসলামী সমাজে নারী, পুরুষ, শ্রমিক, সাধারণ জনতা নির্বিশেষে সকল মানুষ মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণরূপে ভোগ করে। আধুনিক মানবাধিকারের ধারণা পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করে ১৯৪৫ সালে প্রণীত জাতিসংঘ চার্টারে। কিন্তু এর ১৪০০ বছর পূর্বে সমগ্র পৃথিবী যখন জাহিলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত, সে সময় হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবাধিকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আদর্শ মানব সমাজ গঠনে সক্ষম হয়েছিলেন। আলাহ্র নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও শ্রমিক ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি কয়েক কীরাত মজুরিতে মক্কাবাসীদের বকরী চরাতাম” (সহীহুল বুখারী)। মদীনার শাসক হওয়ার পরও সারা জীবন তিনি শ্রমজীবী মানুষের মতো জীবন অতিবাহিত করেছেন। ইসলাম ন্যায়সঙ্গত শ্রম প্রদান করা ও শ্রমিকের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। আলাহ্ তা‘আলা বলেন, “আর এই যে, মানুষ তা পায় যা সে চেষ্টা করে। আর এই যে, তার কর্ম অচিরেই দেখানো হবে। অতঃপর তাকে দেয়া হবে উত্তম প্রতিদান” (সূরা নাজম : ৩৯-৪১)। ইসলাম শ্রমজীবী মানুষকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করে। শ্রমিকদের অধিকারসমূহ নির্ধারণ করেছে।
শ্রমের পরিচয়
শ্রম শব্দের আভিধানিক অর্থ মেহনত, দৈহিক খাটুনী, শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি। অর্থনীতির পরিভাষায় শ্রম বলা হয়, “পারিশ্রমিকের বিনিময়ে উৎপাদনকার্যে নিয়োজিত মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল প্রকার কর্ম-প্রচেষ্টাকে শ্রম বলে।” (আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ২৬৮)। অধ্যাপক মার্শাল শ্রমের সংজ্ঞায় বলেন, অহু বীবৎঃরড়হ ড়ভ সরহফ ড়ৎ নড়ফু ঁহফবৎমড়হব ঢ়ধৎঃষু ড়ৎ যিড়ষষু রিঃয ধ ারবি ঃড় ংড়সব মড়ড়ফ ড়ঃযবৎ ঃযধহ ঃযব ঢ়ষবধংঁৎব ফবৎরাবফ ফরৎবপঃষু ভৎড়স ঃযব ড়িৎশ, রং পধষষবফ ষধনড়ঁৎ. “মানসিক অথবা শারীরিক যে কোনো প্রকার আংশিক অথবা সম্পূর্ণ পরিশ্রম যা আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো ধরনের উপকার সরাসরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়, তাকে শ্রম বলে।” (চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ ঊপড়হড়সরপ, চ. ৫৪).
ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় শ্রমের পরিচয় প্রদানে বলা হয়ে থাকে, “মানবতার কল্যাণ, নৈতিক উন্নয়ন, সৃষ্টির সেবা ও উৎপাদনে নিয়োজিত সকল কায়িক ও মানসিক শক্তিকে শ্রম বলে।” বাহ্যত এ শ্রম উৎপাদন কার্যে ব্যবহৃত হোক কিংবা পারিশ্রমিক না থাকুক অথবা সে পারিশ্রমিক নগদ অর্থ হউক কিংবা অন্য কিছু এবং শ্রমের পার্থিব মূল্য না থাকলেও পারলৌকিক মূল্য থাকবে। (মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে অর্থনীতি, পৃ. ১২২)।
শ্রমের প্রকারভেদ
ইসলামে শ্রমকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে।
ক. শারীরিক শ্রম : শারীরিক বা কায়িক শ্রম হলো পুঁজিবিহীন জীবিকা অর্জনের জন্য দৈহিক পরিশ্রম। যেমন রিক্সাচালক, দিনমজুর ও শ্রমজীবীদের দৈনন্দিন পরিশ্রম।
খ. শৈল্পিক শ্রম : শৈল্পিক শ্রম বলতে বুঝায়, যে কাজে শিল্প ও কৌশলবিদ্যাকে অধিক পরিমাণে খাটানো হয়। যেমন, অংকন, হস্তশিল্প, স্থাপনা ইত্যাদি
গ. বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম : বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম বলতে ঐ সকল পুঁজিহীন শ্রমকে বুঝায়, যেগুলোতে দেহের চেয়ে মস্তিস্ককে বেশি
খাটানো হয়। যেমন, শিক্ষকতা, ডাক্তারী, আইন পেশা ইত্যাদি। (আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ২৬৯)।
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক
আমাদের শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু-ভৃতের সমতুল্য। ইসলামে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্কের ভিত্তি ভ্রাতৃত্বের ওপর রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের সাথে সদ্ব্যবহার, তাদের বেতন-ভাতা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বাণীসমূহ দ্বারা বৈপ্লবিক ও মানবিক শ্রমনীতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। মালিকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সে শ্রমিকের শ্রম টাকার বিনিময়ে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে শ্রমিককে কিনে নেয়নি যে, সে ইচ্ছামত শ্রমিক থেকে শ্রম নেবে। এ জন্য সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ইসলাম মালিক ও শ্রমিক পরস্পরের প্রতি কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আদর্শে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা সকলেই আল্লাহ্তাআলার বান্দা ও পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ্ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খাওয়াতে হবে, যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।
শ্রমিকের প্রতিও আল্লাহ্তাআলা নির্দেশ দিয়ে বলেন, “সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সমর্থ ও আমানতদার” (সূরা কাসাস : ২৬)। অপর আয়াতে আল্লাহ্তাআলা বলেন, “আর মনে রাখবে কোনো জিনিস সম্পর্কে কখনো একথা বলবে না যে, আমি কাল এ কাজ করব” (সূরা কাহাফ : ২৩)। মালিক ও শ্রমিকের প্রতি আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ্তাআলা বলেন, ‘ওয়াদা পূর্ণ কর! ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে” (সূরা ইসরাহ্ : ৩৪)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “শক্তি সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকদের উপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কোনো কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর” (সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “অধীনস্তদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবশে করবে না” (সুনানু ইব্ন মাজাহ্, পৃ. ২৬৯৭)। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মালিকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন কর্মচারী, শ্রমিক ও অধীনস্তদের সাথে সন্তান-সন্তুতির ন্যায় আচরণ করে এবং তাদের মান-সম্মানের কথা স্মরণ রালে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “তাদের এভাবে সম্মান করবে যেভাবে নিজের সন্তানদের কারো এবং তাদেরকে সে খাবার দিবে যা তোমারা নিজেরা খাও” (সুনানু ইব্ন মাজহ্, পৃ. ২৬৯৭)।
মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্মচারীদের কর্তব্য হলো শ্রমিকদের সাথে মিলেমিশে থাকা, কথাবার্তা, উঠা-বসার ক্ষেত্রে ইসলামী ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার ও আচার-আচরণ অবলম্বন করা, মৃত্যু, রোগ-শোক ও অন্যান্য ঘটনা-দুর্ঘটনাকালে নিজেরা উপস্থিত থেকে সহানুভূতি ও সহৃদয় আচরণ গ্রহণ করা।
ইসলাম সাধ্যানুযায়ী ও রুচি অনুযায়ী কাজ করার জন্য মানুষকে জন্মগত অধিকার দিয়েছে। শ্রমিককে এক কাজের জন্য নিয়োগ দিয়ে অন্য কাজ করানো যাবে না যা হয়ত তার জন্য অধিক কষ্টকর। এ জন্য শ্রমিকের স্বাধীন সম্মতি নিতে হবে।
শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ
ইসলাম শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত মজুরি প্রদান করার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম যে কোনো লেনদেনের চুক্তি লিখিতভাবে করার নির্দেশ দিয়েছে। নবী করীম (সা.) বলেছেন, “মজুরি নির্ধারণ ব্যতীত কোনো শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করা অনুচিত” (সুনানু বায়হাকী)। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পারিশ্রমিক নির্ধারণ ব্যতীত শ্রমিকদের থেকে কাজ করে নেয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) বলেন, “যদি তুমি কোনো শ্রমিককে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ দিতে চাও, তবে প্রথমেই তাকে পারিশ্রমিক সম্পর্কে অবহিত করবে?” পারিশ্রমিকই কেবল উৎপাদন সামগ্রীর ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে না, বরং ন্যায়সঙ্গত ঊয়ঁঃধানষব-এর ভিত্তির উপর নির্ধারিত হবে। তাই এতটুকু পরিমাণ পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা উচিৎ যাতে একজন শ্রমিক সম্মানের সাথে জীবন-যাপন করতে পারে। কোনো শ্রমিকের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ করানো হলে অবশ্যই তাকে অতিরিক্ত মজুরি প্রদান করতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “তোমরা তাদের উপর বাড়তি দায়িত্ব চাপালে সে হিসাবে তাদেরকে বাড়তি মজুরি দিয়ে দাও।”

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন