প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান
\ দুই \
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক কাজ করা মাত্রই পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে। চুক্তি অনুসারে প্রত্যেক শ্রমিককে যথাসময়ে পূর্ণ বেতন পরিশাধ করে দিতে হবে। ত্বরিত মজুরি পরিশোধের তাকীদ দিয়ে রাসূলুলাহ্ (সা.) থেকে হাদীস বর্ণিত আছে। হযরত ‘আব্দুলাহ্ ইব্নে ‘ওমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “শ্রমিকের পারিশ্রমিক মজুরি তার ঘাম শুকানোর পূর্বে দিয়ে দাও” (সুনানু ইব্ন মাজাহ্)। নবী করীম (সা.) আরও বলেন, “তিন ধরনের ব্যক্তি আছে কিয়ামতের দিন আমি যাদের দুশমন হবো। আর আমি যাদের দুশমন হবো তাকে আমি লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত করে ছাড়ব। উক্ত তিনজনের মধ্যে একজন সে যে কোনো শ্রমিককে খাটিয়ে নিজের পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয়। কিন্তু তার উচিত মজুরি প্রদান করে না” (সহীহুল বুখারী)।
ইসলামী শ্রমনীতির মূলনীতি
ইসলাম পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে পারস্পরিক মতদ্বৈধতা মীমাংসার ক্ষেত্রে শাশ্বত মূলনীতি প্রদান করেছে। শ্রমিক-মালিকের দায়িত্ব, কর্তব্য, অধিকার ও পাওনা সম্পর্কে মতদ্বৈধতা নিরসনের ক্ষেত্রেও এ মূলনীতি অনুসরণ করে সুফল পাওয়া সম্ভব। একমাত্র এ মূলনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রেও এ মূলনীতি অনুসরণের মাধ্যমেই যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল মানবজাতি কাক্সিক্ষত শান্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে। আল্লাহ্তাআলা ঘোষণা করেন, “তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তবে তা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মুতাবিক মীমাংসা করে নাও” (সূরা নিসা : ৫৯)।
ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা
ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কেননা শ্রমিকই হলো সকল উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। শ্রম আল্লাহ্ প্রদত্ত মানব জাতির জন্যে এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ। এ সম্পর্কে আল-কোরআনে বর্ণিত আছে, “নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি” (সূরা বালাদ : ৩)। কিন্তু ইসলাম বিবর্জিত বিভিন্ন সমাজে শ্রমের বিভিন্নতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে কোনো শ্রম অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আবার কোনো কোনো শ্রম অত্যন্ত অমর্যাদাকর। সেখানে অর্থের মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে যত অর্থশালী সামাজিকভাবে তিনিই তত সম্মানী। যদিও ন্যায়নীতির মানদন্ডে যতই স্বচ্ছ হউক না কেন তারাই সমাজের নিকৃষ্ট ও অবহেলিত ব্যক্তি। তাই দেখা যায় জীবিকা নির্বাহে যারা কায়িক শ্রম নির্ভরশীল তারা আদি যুগের দাসদের চেয়েও হীন হয়ে পড়েছে।
যে কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিকই সবচেয়ে বেশি শ্রম প্রদান করে থাকে। তাই ইসলাম শ্রমিকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের কাজের গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। আল্লাহ্তাআলা কাজের জন্য মানুষকে নামাযের পর বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “অতঃপর নামায শেষ করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়। আল্লাহ্র অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং বেশি পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করো যাতে সফলকাম হতে পার”’ (সূরা জুমু‘আহ্ : ১০)। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কথা, কাজ ও উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে শ্রম ও শ্রমিকদের প্রশংসা করেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা.) বলেন, “কোনো ব্যক্তি তা থেকে উত্তম আহার করেনি, যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে খেয়েছে। আল্লাহ্র নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন” (মাজমা‘উয যাওয়াইদ ওয়া মাম্বাউল ফাউয়াইদ, পৃ. ৬১)। হযরত মিকদাম ইব্ন মাজদী কুরায়ব আয্-যুবায়দী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা.) বলেন, “মানুষের নিকট তার চেয়ে কোনো উত্তম উপার্জন নেই, যা সে নিজের হাতে উপার্জন করে খায়। সে যা কিছু নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য ও ঘরের ভৃত্যদের জন্য খরচ করে তা সবই সাদাকা” (সহীহুল বুখারী, পৃ. ১৯২)। হযরত সা‘দ (রা.) কামারের কাজ করতেন, হাতুড় দিয়ে কাজ করতে করতে তার হাত দু’টি বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। একদিন নবী করীম (সা.)-এর সাথে করমর্দন করার সময় সাদকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, হাতুড় দিয়ে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। নবী করীম (সা.) তার হাত চুম্বন করে বললেন, “এ হাতকে কখনো আগুন স্পর্শ করবে না” (সহীহুল বুখারী, পৃ. ৪)।
ইসলাম অধীনস্ত কর্মচারী ও শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ঘোষণা করেছে। আল্লাহ্তাআলা শ্রমকে নিআমতের সাথে তুলনা করে বলেন, “যাতে তারা তার ফল আহার করে এবং তাদের হাত যা কাজ করে তা হতে; তারা কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?” (সূরা ইয়াসিন, ৩৫)। শ্রমিকদের যেন মানুষ ঘৃণা না করে বরং তাদের সম্মানের চোখে দেখে সে ব্যবস্থা ইসলাম করেছে। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো পেশাই ঘৃণিত নয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা বর্ণনা করে ঘোষণা করেন, আল-কাসিবু হাবীবুল্লাহ্ অর্থাৎ “শ্রমিক হলো আল্লাহ্র বন্ধু” (কানযুল উম্মাল, ৪র্থ খÐ, পৃ. ১২৭)।
ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে শ্রমিকদের মর্যাদা অধিক হিসেবে বর্ণনা করেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ঘোষণা করেন, “ঐ সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমাদের কারও পক্ষে এক গাছা রশি নিয়ে বের হওয়া এবং কার্য সংগ্রহ করে পিঠে বোঝাই করে বয়ে আনা কোনো লোকের কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম। অথচ সে ব্যক্তি তাকে দান করতেও পারে অথবা তাকে বিমুখও করতে পারে” (সহীহুল বুখারী, ১ম খÐ, পৃ. ৩২৫; জামি‘উত্-তিরমিযী, ১ম খÐ, পৃ. ১৪৭; সুনানুন্-নাসা’ঈ, ১ম খÐ, পৃ. ৩৬২)।
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার
ইসলাম শ্রমিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে, এ জন্য ইসলাম সুনির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণ করেছে। যার সাহায্যে আমরা অতি সহজেই একটি ন্যায়নুগ শ্রমনীতি নির্ধারণ করতে পারি। আজকের এ সমাজে ইসলাম শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে নির্দেশনামা প্রদান করেছে, যদি আমরা সেদিকে দৃষ্টি প্রদান করি তাহলে সত্যিকারই একজন শ্রমিক সমাজে যুগান্তকারী সফলতা লাভ করবে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। নি¤েœ শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে ইসলাম যে বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য প্রদান করার কথা বলেছে, তা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো,
ক. শ্রমিকের পেশা নির্ধারণের অধিকার
শ্রমিকের যে বিষয়টি প্রথমেই নির্ধারণ করার বিষয়টি আসে তা হলো তার পেশা বা কাজ নির্ধারণ। কোনো কোনো পেশাকে কোনো কোনো সমাজে বা দেশে নিন্দনীয় মনে করে থাকে। তাই ইসলাম শ্রমিককে তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী পেশা নির্ধারণের অধিকার প্রদান করেছে। ইসলাম এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদার মনোভাব পোষণ করে। মূলত এটি ইসলামের মূল শিক্ষার একটি। ইসলামে কোনো শ্রেণী বৈষম্য নেই। ইসলাম সব ধরনের পেশাকেই সম্মানিত মনে করে। কারণ যত নিন্দনীয় কাজই হোক না কেন তা কিছু লোক না করলে তা কে করবে? যেমন, সুইপারের কাজ।
সমাজের বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শ্রমিকের ওপর কোনো কাজ চাপিয়ে দেয়া অনুচিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ্তাআলা ঘোষণা করেন, “তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন। অতএব, তোমরা তার ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযিক আহরণ কর” (সূরা মুলক, : ১৫)। কোনো পেশাই অসম্মানজনক নয়। বরং পরিশ্রম করে স্বহস্তে উপার্জিত সম্পদ সর্বোত্তম সম্পদ।
খ. যথাযথ পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার
ইসলাম শ্রমিকের পারিশ্রমিক যথাসময়ে পাওয়ার অধিকার প্রদান করেছে। শ্রমের জন্য পারিশ্রমিক প্রদান করা অনিবার্য বিষয়। তাই শ্রমিককে তার যোগ্যতা ও পরিশ্রম অনুযায়ী যথাযথ সম্মানী তথা পারিশ্রমিক প্রদান করা জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন