শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার

| প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম


প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

\ শেষ কিস্তি \
কখনও কখনও কোনো শ্রমিক যথাপ্রাপ্য পারিশ্রমের চেয়েও কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হয়ে সম্মতি প্রদান করলেও মালিকের অপরিহার্য কর্তব্য তার যথার্থ পারিশ্রমিক প্রদান করা। আল্লাহ্তাআলা বলেন, “প্রত্যেকের জন্য তাদের কাজ অনুসারে মর্যাদার স্তর; তাদের কাজের প্রতিফল তাদের দিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না” (সূরা আহ্কাফ, : ১৯)। অপর আয়াতে আল্লাহ্তাআলা বলেন, “আমি তোমাদের কোনো কর্মীর কর্ম নষ্ট হতে দিব না। সে পুরুষ হোক অথবা নারী” (সূরা আলে-‘ইমরান : ৩ : ১১৯৫)। আল্লাহ্র নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা যথাযথভাবে পরিশোধ করার প্রতি তাকীদ প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “মজুর শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি খাদ্য ও পোশাক দিয়ে দাও” (আল-আদাবুল মুফরাদাত, পৃ. ৫৮; সহীহ মুসলিম, ৩য় খন্ড, পৃ. ১২৮৪)। হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ্তাআলা বলেন, “তিন শ্রেণীর লোক এমন যে, কিয়ামতের দিন আমি তাদের প্রতিপক্ষ হবো, যে ব্যক্তি আমার নামে কথা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলো, যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করলো এবং যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে শ্রমিক নিয়োগ করে তার নিকট থেকে পূর্ণ কাজ বুঝে নিল; কিন্তু তাকে তার সঠিক পারিশ্রমিক প্রদান করলো না” (সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮১-৪৮২; সুন্নাু ইব্ন মাজাহ্, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৭১)।  
শ্রমিকের পাওনা যথা সময়ে ত্বরিত গতিতে প্রদান করা আকশ্যক। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও” (সুনানু ইব্ন মাজাহ্, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৭২)। শ্রমিককে তার নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা অপরাধ ও অন্যায়। একই সাথে তাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো কিংবা কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য ইসলাম মালিক পক্ষকে সাবধান করেছে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “শ্রমিকরা তোমাদেরই ভাই। অতএব তাদের সাথে সদয় ব্যবহার কর। তোমাদের একার পক্ষে যে কাজ করা অসম্ভব, তাতে তাদের সাহায্য নাও। আবার তাদের একার পক্ষে যে কাজ করা অসম্ভব, তাতে তোমরাও তাদেরকে সাহায্য দাও” (আল-আদাবুল মুফরাদাত, পৃ. ১৯০; আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৯৬৭২)। অপর হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা,) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নিবে, তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পুণ্য লেখা হবে” (শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৮৩৪৩, ১৮শ খÐ, পৃ. ১১০)। যে কোনো কর্মচারীর নিয়োগের প্রথমেই বেতন নির্ধারণ করা আবশ্যক। কেননা বেতন নির্ধারিত না হলে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই শ্রমীকের বেতন নির্দিষ্ট না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করতে ইসলামে নিরুৎসাহিত করেছে।   
গ. শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্যে অংশীদারিত্ব প্রাপ্তির অধিকার
সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদ সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকদের লাভের কোনো অংশীদারিত্ব প্রদান করে না; বরং মূল বেতন দেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেয়া হয়। ইসলাম শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যে তথা মুনাফায় অংশীদারিত্ব প্রদান করে থাকে। কেননা, পুঁজি ও শ্রমের সমন্বয়ের ফলেই উৎপাদন হয়।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বহুদিন পর্যন্ত মুদারাবাতের ভিত্তিতে নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভের অংশীদার হিসেবে হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা.)-এর ব্যবসায় শ্রম দিয়েছেন। ইসলাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিককে লভ্যাংশের অধিকার প্রদান করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নির্দেশ, ‘মজুর, শ্রমিককে তার শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য হতেও অংশ প্রদান কর। কারণ আল্লাহ্র শ্রমীককে কিছুতেই বঞ্চিত করা যায় না।’ (মুসনাদু আহ্মাদ)। আল্লাহ্তাআলা বলেন, ‘বিত্তবানদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে” (সূরা যারিয়াত : ১৯)। অপর আয়াতে আল্লাহ্তাআলা আরও বলেন, ‘যেন তারা তার ফল পেতে পারে যা তাদের হাত দ্বারা করা হয়েছে” (সূরা ইয়াসিন : ৬৫)। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এদিকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, “শ্রমিকদেরকে তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ থেকেও অংশ দাও। কারণ আল্লাহ্র মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না” (আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৮২৫০)।
ইসলামের বিধান হলো সম্পদ মালিক-শ্রমিক, ধনী-দারিদ্র্য সকলের ভিতর আবর্তিত হোক এবং সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের মৌলিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। আল্লাহ্ তা‘আলা এ সম্পর্কে ঘোষণা করে বলেন, “সম্পদ যেন শুধু ধনী শ্রেণীর লোকদের মধ্যে আবর্তন না করে” (সূরা হাশর : ৭)। ইসলাম শ্রমজীবী মানুষের বেতনের বাইরে লাভের অংশ দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। কোনো কারখানা শ্রমিকদের যদি লভ্যাংশের সামান্য অংশ বছর শেষে বেতনের বাইরে অতিরিক্ত দেয়া হয়, তাহলে শ্রমিকরা সে কোম্পানির নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য জীবন বাজী রাখবে তা নিশ্চিতরূপে বলা যায়।
ঘ. বাসস্থান পাওয়ার অধিকার
প্রত্যেক স্বাধীন ব্যক্তির যেমন বাসস্থান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তদ্রæপ একজন শ্রমিকেরও বাসস্থান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ইসলাম মালিক-শ্রমিক উভয়কেই সমান অধিকার প্রদান করেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, “যে আমাদের কোনো দায়িত্বেব নিযুক্ত হলো অথচ তার কোনো ঘর বা বাসস্থান নেই, তাকে সে যেন আবাসিক ঘর বানিয়ে দেয় অথবা যার স্ত্রী নেই সে যেন বিয়ে করে নেয় অথবা যার কোনো ভৃত্য নেই, সে যেন ভৃত্য গ্রহণ করে অথবা যার বাহন নেই সে যেন একটি বাহন করে নেয়” (আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৩২৯)। ইসলাম সকল মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য তাগিদ দিয়েছে। প্রতিটি আদম সন্তানের জন্য অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “প্রতিটি আদম সন্তানের জন্য এ বস্তুগুলোর মধ্যে অধিকার রয়েছে। বাসস্থানের জন্য ঘর, লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য বস্ত্র এবং স্বাভাবিক খাদ্য ও পানীয়” (জামি‘উত্-তিরমিযী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯)।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামী অর্থনীতিতে শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। যেখানে শ্রমিক-মালিকের দ্ব›দ্ব ও সংঘাতের অবকাশ নেই। দুয়ের সম্মিলিত চেষ্টা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতার ফলে শিল্পের ক্রমাগত উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক। সর্বোপরি মু’মিন-মুসলমানদের শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তারা ঈমানের তাগিদে ও পরবর্তীকালের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই শ্রমনীতি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। অন্য কোনো ধরনের অর্থনীতি বা প্রত্যাশা করা একেবারেই অসম্ভব, “দুনিয়ার মজদূর এক হও” ¯েøাগান সর্বস্তরে সমাজতন্ত্রের বাধ্যতামূলক শ্রমদান যেমন এখানে অনুপস্থিত, তেমনি পুঁজিবাদের মালিকের অবমাননকর শর্ত ও লাগামহীন শোষণও নেই। “শ্রমিক ও মালিক পরস্পর ভাই ভাই” এ বিপ্লবাত্মক ঘোষণাই ইসলামী শ্রমনীতির মূল উপজীব্য। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আই.এল.ও এখন পর্যন্ত এ নীতি গ্রহণের বা স্বীকারের সৎ সাহস দেখাতে পারেনি। একমাত্র ইসলামী বিধি-বিধানই শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সালাম-এর প্রবর্তিত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থাই পারবে শ্রমিকের মৌলিক অধিকার ও মানবিক শ্রমনীতির পূর্ণ বাস্তায়বন করতে।
লেখক : প্রবন্ধকার, গবেষক, প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন