শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

‘শিশু হত্যা বৃদ্ধি সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ’

প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান-উজ-জামান : আমরা ক্রমেই হিংস্র হয়ে উঠেছি। মমতাময়ী মায়ের কোলেও আজ নিরাপদ নয় আদরের শিশু।  হিংসাত্মক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ না ঘটলে যে কোন শিশুকেই হত্যা করা সম্ভব নয়। হবিগঞ্জে ৪ শিশুর পর রামপুরায় নিজ বাসায় ২ শিশু ভাই-বোন হত্যা যেন বলে দেয় সকল অমানবিকতা, বর্বরতা ও হিংস্রতাকে হার মানিয়েছে এ ঘটনা। ২০১৪ সালে বাবা-মায়ের মাধ্যমে ৪০টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। গত বছর সংখ্যা একটু কম ছিল। শিশু হত্যার এসব ঘটনাকে মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, শিশুদের জন্য আগামী পৃথিবী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। মানবাধিকার কর্মীদেরই প্রশ্ন এমনও অমানুষ কেউ হতে পারে? চারপাশের এসব নির্মম ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সমাজ ব্যবস্থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিশু হত্যা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সমাজ ও মনোবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টিজনেরা তাদের মতামত তুলে ধরেন, গতকাল বিকেলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে আলোচনাকালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রুমা খন্দকার বলেছেন, রামপুরার ঘটনায়  শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এমন কথা চিন্তা করে মা তার দুই শিশুকে হত্যা করেছে এ বিষয়টি একেবারেই সত্য নয়, এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে। হয়ত ওই মায়ের নিজের উপরে অনেক কষ্ট আছে কিংবা কারো উপরে কোনো ক্ষোভ রয়েছে এই বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে শুধু ‘মা’ এই আদর্শ রোল থেকে চিন্তা করলে অনেক কিছুই অজানা থাকবে।
রামপুরায় দুই শিশু হত্যাকা-ের ঘটনায় মা জড়িত থাকাকে একটু ভিন্ন চোখেই দেখছেন সমাজের বিভিন্ন মহল। কেউ বলছেন একজন মা হয়ে কিভাবে তার সন্তানদেরকে হত্যা করতে পারেন। যদিও প্রথমে বলা হয়েছিল রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে শিশু দুইটি মারা গেছে। কিন্ত পরবর্তী সময়ে র‌্যাবের অভিযানে শিশু দুইটির ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসে সব রহস্য। মা নিজেই হলেন ঘাতক! মেয়ের গলার ওড়না দিয়ে মেয়েকে হত্যা করার পর সেই ওড়না দিয়েই ছেলেকে হত্যা করা হয়- এমনটিই স্বীকার করেন মা। কিন্তু কেন তার সন্তানদেরকে হত্যা করেছেন? র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চত; তাই মা দুই শিশুকে হত্যা করে। রুমা খন্দকার বলেন, শুধু মা হিসেবে দোষারোপ না করে সত্য ঘটনাগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহসচিব, এডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, শিশু হত্যা ও নির্যাতন হঠাৎ করেই বেড়েছে। এটি সামাজিক অসুস্থতার লক্ষণ। যে কোন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অশান্তি বিরাজ করলে এর প্রভাব পড়ে সেখানের নারী ও শিশুদের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের ওপর যেভাবে নির্যাতন বেড়েছে তাতে দেশ কোন পর্যায়ে চলছে সেটির আর বলে বোঝানো দরকার পড়ে না। রামপুরায় মায়ের হাতে দুই শিশু নিহত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু লেখা ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই দু’টি সন্তানকে মা হত্যা করবে? আমার কাছে মনে হচ্ছে র‌্যাব এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা দিয়েছে। ঘটনাটির পেছনে  অন্য কারণও থাকতে পারে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা এ বিষয়টি তদন্ত করছে। তদন্তের পরেই এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাবা-মায়ের মাধ্যমে ৪০টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। গত বছর সংখ্যা একটু কম ছিল। সামাজিক অস্থিরতার প্রতিফলন ঘটছে শিশুদের ওপর। উপজেলা পর্যায়ে শিশুর অধিকার রক্ষায় কর্মকর্তা থাকলে শিশুর বিষয়টি আলোচনায় থাকত। তিনি বলেন, এদের রোধ করতে এনজিওগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। পারিবারিক অস্থিরতার কারণে ঘরের মধ্যে পরিবারের লোকজনই ঠান্ডা মাথায় শিশুদের খুন করছে। শিশু হত্যাকারী যে-ই হোক, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে কোনো উদ্যোগেরই সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক শিশু হত্যার চিত্র বলে দেয় শিশু হত্যা আজ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। শিশু নির্যাতনের প্রধান কারণ সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। মানুষের মধ্য থেকে মানবিকতা, সুকুমার বৃত্তি উঠে যাচ্ছে। মানুষ পরিণত হচ্ছে মায়া-মমতাহীন এক নিষ্ঠুর প্রাণীতে। বর্বরতা ও নির্মমতার লোমহর্ষক শিশু নির্যাতন দেখে প্রশ্ন জাগে, যেখানে মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দেন, আর এখন দেখা যাচ্ছে খোদ মা সন্তানকে নিজ হাতে হত্যা করছেন! এসব ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, নৈতিকতার শিক্ষাসহ সর্বস্তরে জনমত গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্কুল পর্যায়েও কাউন্সেলিং চালু করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আকাশ সংস্কৃতি, পাশ্চাত্য মূল্যবোধগুলো আমরা আংশিক বা বিকৃতভাবে গ্রহণ করছি। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বিস্তার ঘটেছে। মা বা বাবা কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, সন্তানেরা তা জেনে গেলে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। চারপাশে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির উপাদান ছড়িয়ে আছে। মাদকাসক্ত মা বা বাবা সন্তানকে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলছেন।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, বাবা-মা সন্তানকে মারতেও দ্বিধা করছেন না। মানুষের মধ্যে হিংসাত্মক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ না ঘটলে শিশুকে হত্যা করা সম্ভব না। গণমাধ্যমসহ সবাই একসঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে এখন এই সন্ত্রাস অনেকটাই কমে এসেছে। একইভাবে শিশু হত্যার বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের হাতেও শিশুরা রেহাই পাচ্ছে না। যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সময় নষ্ট করার কোনো অবকাশ নেই। সবাই মিলে কিছু একটা করতেই হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন