মাওলানা আবদুর রাজ্জাক
\ এক \
মেধাসম্পদ মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে সতন্ত্র করে তুলেছে। তথ্যের সমুদ্রে অবাধ বিচরণ, জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করা ও সৃজনশীলতার পরম বিকাশের যোগ্যতা মানুষকে করে তুলেছে অসাধারণ। ছোট একটি তথ্য অসংখ্য মানুষের উপকারে লেগে যেতে পারে। জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও সঠিক প্রয়োগ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আধুনিকময় ভবিষ্যতের দিকে। মাত্র একজন মানুষের সৃজনশীলতা সমগ্র জাতিকে দিতে পারে আগামীর পথনির্দেশনা। পৃথিবীর সূচনা থেকে নবী রাসূলগণ বিশ্ব-জগতের স্রষ্টার, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নামের তথ্য আবিষ্কার করে জাতিকে দিয়েছেন সমৃদ্ধ জ্ঞানের সন্ধান ও সঠিক দিকনির্দেশনা। হেরা পর্বতের গুহা থেকে ঐশি জ্ঞানের সন্ধান দিয়ে বিশ্বনবী (সা.) জাহিলিয়াতের অন্ধকারে ডুবে থাকা সমাজকে দিয়েছেন আলোর সন্ধান। এমন অনেক কারণে মেধাসম্পদ অমূল্য। এর উদ্ভব, সংরক্ষণ ও বিকাশে প্রতিটি মানুষের সচেতন হয়ে ওঠা প্রয়োজন।
মেধাসম্পদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়ে তুলতে প্রতি বছর ২৬ এপ্রিল পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস। দিবসটিকে ছড়িয়ে দিতে জাতিসংঘ বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে। এর সাথে যোগ দিয়েছে নানা রাষ্ট্র ও সংগঠন। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস সম্পর্কে মানুষ আরো বিশদভাবে জানতে পারছে এবং এ বিষয়ে কথা বলছে। ব্যাপক মানুষের আলোচনার ফলে ওঠে আসছে মেধাভিত্তিক সম্ভাবনার নানান দিক। চিহ্নিত হচ্ছে এ বিষয়ে বিপরীত প্রতিবন্ধকতা ও সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের উপায়।
মেধাসম্পদ দিবস প্রথম পালন করা হয় ১৯৭০ সালে। প্রতি বছর দিবসটিকে ঘিরে একটি প্রতিবাদ্য বা শ্লোগান নির্বাচন করা হয়। বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা এই বিশেষ দিবসটিকে নিয়ে নানা আয়োজন করে। মানুষকে তার সৃজনশীলতা সংশ্লিষ্ট অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে। বাংলাদেশও বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র।
মেধাসম্পদ সংরক্ষণ-সমৃদ্ধি ও এর সঠিক প্রয়োগের বিষয়ে আমাদেরও কিছু ভাববার ও লিখবার অবকাশ ও অধিকার আছে। শুধু তাই নয়; মেধার সঠিক প্রয়োগের দিকনির্দেশনা করা আমাদের দায়িত্বও।
জাতিসংঘ এবং বিশ্ব মানবসম্পদ সংস্থার রাষ্ট্রগুলো সাধারণত সৃজনশীল কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং মেধাসম্পদ সংশ্লিষ্ট অধিকার বিষয়ে মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কপিরাইট, বই, গান, শিল্পকর্ম, আলোকচিত্র, চলচিত্র, সফটওয়্যার, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক, ট্রেড সিক্রেট ও উদ্ভাবনকেই মেধাসম্পদ হিসেবে গণ্য করে থাকে। প্রযুক্তিগত উপকরণকে ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়াকেই মেধা সম্পদের যথাযথ প্রয়োগ মনে করে। একক বা সমবেত সৃজনশীলতার সুফল যে বৃহত্তর সমাজ ভোগ করে তা অস্বীকার করা যায় না। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রের মেধাসম্পদ প্রয়োগর সুফল ভোগ করছে সব শ্রেণির নাগরিক। তবুও মেধাসম্পদের অপব্যবহার, অবমূল্যায়ন হচ্ছে তা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। আমরা মনে করি, মেধাসম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ সঠিক প্রয়োগ ও মূল্যায়নের অভাবে আজ অশান্তির দাবানল জ্বলছে। অসভ্যতার বিষবাষ্প সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। মেধা সম্পদের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মানবসম্পদও ধ্বংস হচ্ছে।
মেধা কী?
মেধা ও প্রতিভা হচ্ছে সম্ভাবনা। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু কিছু বিষয়ে সহজাত আগ্রহ থাকে, কিছু কিছু কাজের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থাকে। এই আগ্রহ স্বতঃস্ফ‚র্ত হতে পারে আবার অনুপ্রেরণাজাতও হতে পারে। এটাই একজন মানুষের গুণ বা বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়। এই গুণ বা বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মেধা। অর্থাৎ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে কোনো কাজ বা বিষয়ের প্রতি আকর্ষণবোধ করাটাই হচ্ছে সে বিষয়ে তার মেধা। এই মেধাকে যখন মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হয় তখন তা সেবায় রূপান্তরিত হয়। প্রতিটি মানুষের মাঝে অফুরন্ত মেধা সুপ্ত আছে। স্বতঃস্ফ‚র্ত আগ্রহ বা অনুপ্রাণিত হয়ে এটি বিকশিত হতে পারে। তার ক্রমাগত অনুশীলনে যা অর্জন হয় তা দক্ষতা।
জ্ঞান কী?
মেধার আরেকটি প্রতিশব্দ জ্ঞান। জ্ঞান বলতে প্রচলিত ভাষায় আমরা যা বোঝাই তা আসলে তথ্য। যেমন ‘করলা’ একটি সবজি যার স্বাদ তেঁতো, রং সবুজ। এগুলো হলো তথ্য; কিন্তু এ তথ্যগুলোকে আমি কীভাবে কাজে লাগাব সেই বিবেচনার নাম হলো জ্ঞান। যেমন একটি গাড়ির রং কালো, এটি একটি তথ্য। এ গাড়িটিকে আমি কীভাবে চালাব, এটা দিয়ে কল্যাণ করব না অকল্যাণ করব, অর্থাৎ তথ্য ব্যবহার করার কল্যাণকর বা অকল্যাণকর দিক সম্পর্কে সচেতন হওয়ার নাম হচ্ছে জ্ঞান। আর স্বতঃস্ফ‚র্তভাবেই কেউ যখন বুঝতে পারে যে, কল্যাণ কী? অকল্যাণ কী? এ কাজটি তার জন্য কল্যাণকর হবে কি হবে না সেটাই হলো প্রজ্ঞা। যেমন কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যখন স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটাই হলো প্রজ্ঞা। জ্ঞান বা প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোই হলো মূল বিষয়। জ্ঞানকে আরবিতে বলা হয় ‘আল-আকল’। যার অবিধানিক অর্থ হচ্ছে বাধা দেয়া। আর জ্ঞানকে ‘আকল’ এজন্যই বলা হয় যে, জ্ঞান মানুষকে ধ্বংস থেকে বাধা দেয়, বিরত রাখে। আরবিতে জ্ঞানকে ‘হিজর’ও বলে। কালামে পাকে ইরশাদ হচ্ছে, “এর মধ্যে আছে শপথ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য”। -সুরা আল ফজর-৫
এখানে জ্ঞানী ব্যক্তি বোঝানোর জন্য ‘হিজর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘হিজর’ শব্দের অর্থও বাধা দেয়া। মুফাস্সিরগণ বলেছেন, মানুষের বিবেক মানুষকে মন্দ ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে বাধা দান করে। তাই ‘হিজর’ শব্দের অর্থ বিবেকও হয়ে থাকে। এখানে তাই বোঝানো হয়েছে।
মেধাসম্পদের সঠিক প্রয়োগ
উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হলো- যে ব্যক্তি বা জাতির বিবেক তাকে মন্দ ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে বাধা প্রদান করে না তার বিবেক ও মেধা সংরক্ষিত হয়নি। সে মেধার সঠিক প্রয়োগ করেনি। সে মন্দকে মন্দ জ্ঞান করার পরও তা বর্জন করল না। সত্যকে সত্য জানার পরও তা গ্রহণ করল না। সে মেধার সঠিক প্রয়োগ করেনি।
মানুষের মধ্যকার সুপ্ত এই মেধ সম্পদ দান করেছেন মহান আল্লাহ তা‘আলা। যারা নিজস্ব মেধাসম্পদের সঠিক প্রয়োগ করে না, মহান আল্লাহ তাদেরকে লক্ষ্য করে কালামে পাকের বিভিন্ন স্থানে বলেছেন, “আফালা তা’কিলূন” তোমরা কি বুঝনা?
যারা মেধাসম্পদের সঠিক প্রয়োগ করে না , আল্লাহতায়ালা তদেরকে কালামে পাকে অন্ধ, বধির, উন্মাদ, গাফেল ও চতুষ্পদ জন্তুর সাথে তুলনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “আর আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না। তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না। আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল শৈথিল্যপরায়ণ। -সুরা আ’রাফ-১৭৯
এ আয়াতে সেসব লোকের বোঝা, দেখা ও শোনাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে, এরা কিছুই বোঝে না, কোন কিছু দেখেও না। অথচ বাস্তবে এরা পাগল বা উন্মাদ নয় যে, কিছুই বুঝতে পারে না। অন্ধও নয় যে, কোনো কিছু দেখবে না, কিংবা বধিরও নয় যে, কোনাে কিছু শোনবে না; বরং প্রকৃতপক্ষে এরা পার্থিব বিষয়ে অধিকাংশ লোকের তুলনায় অধিক সর্তক ও চতুর।
কিন্তু কথা হলো এই যে, আল্লাহতায়ালা স্বীয় সৃষ্টিসমূহের মধ্যে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রয়োজন অনুপাতে তার জীবনের লক্ষ্য অনুযায়ী বুদ্ধি ও উপলব্ধি ক্ষমতা দান করেছেন। যেসব জিনিসকে আমরা বুদ্ধি বিবর্জিত ও অনুভ‚তিহীন বলে মনে করি, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনা-অনুভ‚তি বিবর্জিত নয়। অবশ্য এসব বিষয় সেগুলোর মাঝে সে অনুপাতেই দেয়া হয়েছে যেটুকু তাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন। সবচেয়ে কম বুদ্ধি ও চেতনা-উপলব্ধি রয়েছে মাটি, পাথর প্রভৃতি জড়পদার্থের মাঝে। যাদের না আছে প্রবৃদ্ধি, না আছে স্বস্থান থেকে কোথাও যাওয়া কিংবা চলাফেরার প্রয়োজন। কাজেই এতে সে শক্তি-সামর্থ্য এতই ক্ষীণ যে, তাদের জীবনীশক্তির আন্দাজ করাও কঠিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন