মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ

রাজউক কর্মচারীদের নামে ৫০ প্লট

| প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


অনিয়ম কারণে সরকার সিদ্ধান্ত দিলে বরাদ্দ বাতিল হবে -রাজউক চেয়ারম্যান
আয়কর সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও জমা দেয়নি -তদন্ত প্রতিবেদন

উমর ফারুক আলহাদী : রাজউকের প্লট বরাদ্দে সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে রহস্যজনক কারণে নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা পাঁতারা চালিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। প্লট বরাদ্দের এই অনিয়মটি স¤প্রতি ধরা পড়লেও ২০০৩ সালে বিগত সরকারের সময়েই এই প্লটগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সে সময় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে ১৫ হাজার প্লট বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দেয় রাজউক।ওই সময় রাজউকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পক্ষ থেকে আবেদনকারীদের ৫০ জন ব্যক্তিকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে কোন ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আবেদনের সাথে জমা না দিয়েই এসব প্লট বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগও প্রমানিত হয়েছে সম্প্রতি। এটিকে আশ্চর্যজনক বলছেন সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল।
তিনি বলেছেন, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে বরাদ্দ বাতিল করা হবে।পাশাপাশি  নিরীক্ষা বিভাগের দ্বিমুখী  সিদ্ধান্তের পেছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, বিগত সরকার আমলের এসব অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে । খুব দ্রæত বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ উঠলে মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত ওই তদন্ত  প্রতিবেদনেই অনিয়ম দুর্নীতি চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্টারা জানিয়েছেন, সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে ৫০টি প্লট বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থ এখনও নেয়া হয়নি। তবে রাজউক বলছে বিষয়টি তদন্তাধীন। এ ব্যপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সেই সিদ্ধান্ত মোতাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এসব অনিয়ম এখন হয়নি। এটা বহু আগের ঘটনা। বিএনপি সরকারের সময়ে এই বরাদ্দ হয়েছে। কে পেয়েছে, কীভাবে পেয়েছে তা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এখন এসব প্লট থাকবে কি থাকবে না সেটা সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সরকার বা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দিবে আমরা সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেব।
জানা যায়,রাজউকের তৎকালীল চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী, ফয়েজ, একেএম ওয়াহেদুল ইসলাম, সদস্য (অর্থ) এসএম জাফরুল্লাহ, সদস্য (সম্পত্তি) এইচএম জহুরুল হকসহ ১০ কর্মকর্তা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে  জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে তাঁদের কেউই এখন এই সংস্থায় কর্মরত নেই।
ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকলেও প্লট পেয়েছেন রাজউকের ঝাড়ুদার, কেরানি এমনকি নিরাপত্তা প্রহরীও। নিরীক্ষা বিভাগ এ অনিয়ম তুলে ধরে তা সংসদীয় কমিটিতে পাঠায়। সংসদীয় কমিটি ঘটনাটি আরও তদন্ত করে দায়ীদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তাতেও উঠে আসে একই অনিয়ম। এসব অপরাধের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে, সমাধানের সুপারিশ করে নিরীক্ষা অধিদফতর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল উপশহর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাগিয়ে নেয়া ৫০টি প্লট বাতিল না করে সমাধানের সুপারিশ করেছে সরকারের নিরীক্ষা অধিদফতর। অথচ এসব প্লট বরাদ্দে ন্যূনতম নীতিমালা বা শর্ত মানা হয়নি। প্রথম অবস্থায় এই অনিয়ম তুলে ধরে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে নিরীক্ষা অধিদফতর। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই কিছু যুক্তি তুলে ধরে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সুপারিশ করে একই সংস্থা। নিরীক্ষা অধিদফতরের দ্বিমুখী এই আচরণে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন সংসদীয় কমিটি।
রাজউক সূত্র জানিয়েছে, সংস্থার বিভিন্ন পদে কর্মরত এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্লট বরাদ্দে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। বরাদ্দের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাচাই করলে বরাদ্দপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তাদের আবেদন বাতিল হয়ে যেত। এ প্লটগুলো অনিয়মের মাধ্যমেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৬ জন পেয়েছেন তিন কাঠার প্লট। দু’জন পেয়েছেন পাঁচ কাঠার এবং বাকি দু’জন সাত কাঠার প্লট পেয়েছেন। বিগত সরকারের আমলে নিজেদের সমর্থক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুষ্ট রাখতেই এই অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব প্লটের কোন কোনটির বর্তমান বাজার মূল্য দুই কোটি থেকে সাত কোটি টাকা।
রাজউক সুত্র মতে যারা প্লট পেয়েছেন তারা হলেন, জরিপকার তাজুল ইসলাম, যান্ত্রিক বিভাগের অফিস সহকারী আলী আকবর খান, জরিপ সাথী মো. সালাউদ্দিন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) সফিকুল ইসলাম, পিয়ন আ. হামিদ ভাসানী, কার্য তদারকি আমান উল্লাহ, অফিস সহকারী মোহাম্মদ সালেহা বেগম, অফিস সহকারী আবু হানিফ, আনোয়ার হোসেন, সেলিম মিয়া, মাজেদা খাতুন, হুমায়ুন কবির, গাড়িচালক আবু তাহের, আলী আকবর, হাসান আলী, জরিপ সাথী আক্কাছ আলী, অফিস সহকারী হুমায়ুন লস্কর, সহকারী স্থপতি খুরশীদ জামিন হোসেন, নিম্নমান সহকারী জাহিদুল ইসলাম, পিয়ন মোশাররফ হোসেন, চালক আবুল হোসেন শেখ, শাহনাজ পারভীন, অফিস সহকারী মোর্শেদা বেগম, ড্রাফটম্যান মামুনুর রশিদ, পিয়ন সুরুজ আলী, সুপারভাইজার সাইফুল আলম, অফিস সহকারী আবদুল হক, কার্য তদারকি রফিকুল ইসলাম বেপারী, শ্রমিক সুলতান বেপারী, নিম্নমান সহকারী কবির উদ্দিন, জরিপ সাথী আব্দুল খালেক, অফিস সহকারী মনিরুজ্জামান সিকদার, আবু সালেক সিকদার, নুরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান গাজী, সিনিয়র সহকারী সাবিনা ইয়াসমিন, কার্য তদারকি আ. রহমান, নিম্নমান সহকারী সাহাব উদ্দিন, সহকারী নূর হোসেন, সহকারী স্থপতি মোর্শেদা বানু, নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম,  মুদ্রাক্ষরিক অনন্ত কুমার সরকার, সাখাওয়াত হোসেন, উচ্চমান সহকারী পাপিয়া রহমান, অফিস সহকারী কামরুল ইসলাম সরকার, আবুল হোসেন, মনোয়ারা বেগম, আ. মান্নান, হারুন অর রশিদ ও ড্রাফটম্যান কামাল হোসেন। সস্প্রতি সংস্থাটির পূর্বাচল উপশহর প্রকল্প নিয়ে রাজউকের প্লট বরাদ্দ কার্যক্রম পরিদর্শনে যায় সরকারের নিরীক্ষা অধিদফতর (সিজিএ)। প্রতিষ্ঠানটির পরিদর্শনে বরাদ্দে অনিয়ম পাওয়ায় অধিদফতর এ ব্যাপারে আপত্তি তোলে। পরে গত বছরের শেষের দিকে বিষয়টি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপনকালে সংসদীয় কমিটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়।তবে এরই মধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্তরা অনেকই প্লটের পুরো কিস্তি পরিশোধ করেছেন। কেউ কেউ নিজের নামে রেজিস্ট্রিও করে নিয়েছেন। কেউ কেউ প্লট বুঝে পেয়ে বিক্রিও করে দিয়েছে।
২০০৪ সালে রাজউকের দুটি বিশেষ সভায় সংস্থার কর্মকর্তা- কর্মচারীদের প্লট দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখানে শর্ত ছিল আবেদনকারীর আয়কর সনদসহ যাবতীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার। এতে আরও বলা হয়েছিল, কর্মকর্তাদের ৩ কাঠা প্লটের জন্য ৬০ এবং ৬ কাঠার জন্য ৬৪ নম্বর পেতে হবে। অথচ এতে মাত্র ৩১ নম্বর পেয়েও প্লট পেয়েছেন বেশ কয়েকজন। এমন ৫০ জনের কেউ নির্ধারিত নম্বর পাননি এমনকি দরকারি কাগজপত্রও জমা দেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন,রাজউকের প্লট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে আবেদনকারীকে বেতন স্কেল, বয়স ও চাকরির অভিজ্ঞতাকাল মিলিয়ে নির্ধারিত ১০০ নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৬০ নম্বর পেতে হবে। কিন্তু বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কেউ ৬০ নম্বর পাননি। ফেল করা ব্যক্তিরাও প্লট পেয়েছেন। এদের কেউ আয়করও দেন না। শর্তানুযায়ী আবেদনপত্রের সঙ্গে আয়কর সনদ দেয়ার কথা। যারা এই সনদ দেবেন না তাদের আবেদন বাতিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারও আবেদন বাতিল করেনি তৎকালীন রাজউক কর্তৃপক্ষ।
২০১০ সালের এই অনিয়ম তদন্ত করে সরকারের নিরীক্ষা বিভাগ। এতে বলা হয় প্লটগুলো বরাদ্দে শর্ত মানা হয়নি। জেনুইন রিজার্ভের কোটায় বরাদ্দের মানদন্ড ঠিক করা হয়নি। তদন্ত কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর নিরীক্ষা বিভাগ থেকে বলা হয় এই ৫০টি প্লট বাতিল ও দায়ীদের শাস্তি দেয়ার কথা। ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি আরও একটি চিঠি দেয় নিরীক্ষা বিভাগ। এতে প্লট বাতিল বা শাস্তির বদলে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে সুপারিশ করা হয়। অথচ এমন সুপারিশ করার কোনও এখতিয়ার নেই অডিট বিভাগের।
শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই অনিয়ম নয়, অনিয়ম হয়েছে অন্যান্য প্লট বরাদ্দেও। প্রকল্পে লটারিতে নাম উঠেনি, এমন কি আবেদনও করেননি এমন ব্যক্তিরাও প্লট পেয়েছেন। অনিয়মের মাধ্যমেই এসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৫০ প্লট ছাড়া আরও ৫০০ প্লটে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। সরকারের নিরীক্ষা অধিদফতর ও পূর্তমন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যও বেরিয়ে এসেছে।
এ বিষয়ে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর বলেন, অডিটের দুটো রিপোর্টের মধ্যে যে বৈষম্য তা আমার চোখে এসেছে। আমি এটুকু প্রতিশ্রæতি দিচ্ছি এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।##

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Ismail hossain (Merchandising Manager) ২১ মে, ২০১৭, ১১:৪২ এএম says : 0
This is Bangladesh Government/ Rajuk Management
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন