মাহফুজ আল মাদানী : বাংলাদেশ ভাটির দেশ। এ দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও এখন আর ছয়টি ঋতু তেমন পরিলক্ষিত হয় না। গরম, ঠান্ডা আর মেঘ-বৃষ্টিতে দেশের ঋতুগুলো সীমাবদ্ধ বললেই চলে। ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল হিসেবে পরিচিত থাকলেও মেঘের গর্জন, বজ্রধ্বনি, বজ্রপাত আর প্রচন্ড বৃষ্টিতে বসন্তকালকে ভুলিয়ে দেয়। আবহাওয়াতে বসন্ত বয়ে যাওয়া দূরের কথা, মানুষের মনেও বসন্তের হাওয়া বয়ে যায় না। আর বয়ে যাবে বা কেমন করে? আবহাওয়ার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করলে আবহাওয়ার সাথে সাথে মানুষের দুচোখ বেয়ে বৃষ্টি ঝরে। এরপরও জীবন থেমে থাকার নয়। চলছে, চলবে তার আপন গতিতে। কিন্তু কখন মেঘ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান, ধমকা হাওয়া, বজ্রধ্বনি শুরু হবে তা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউই জানে না। আর জানবেই বা কেমন করে? এসবের চাবিকাটি তো তাঁর হাতে। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, অদৃশ্যের চাবি পাচঁটি। অতঃপর তিনি তেলাওয়াত করলেন, ‘আল্লাহ তা’আলারই কাছে কিয়ামতের ইলিম (জ্ঞান) এবং তিনিই মেঘ বৃষ্টি নাজিল করেন’ -(বোখারী)।
বাতাস। মানুষের জন্য উপকারী। অপকারীও বটে। তাই বলে বাতাসকে গালমন্দ করা যাবে না। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। হাদীস শরীফে বাতাসকে গালমন্দ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, বাতাস আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণ নিয়ে আসে, আবার শাস্তিও নিয়ে আসে। অতএব তোমরা বাতাসকে গালমন্দ করো না, বরং আল্লাহর কাছে এর কল্যাণকর দিকটির প্রার্থনা কর এবং এর অকল্যাণকর দিকটি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর’ -(শাফেয়ী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী)। অন্য এক হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির বাতাসকে অভিশাপ দেয়াকে নিষেধ করেছেন। হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার এক ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে বাতাসকে অভিশাপ দিল। তখন নবী করিম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা বাতাসকে অভিশাপ দিও না। কারণ এটা আদেশপ্রাপ্ত হয়ে এসেছে। আর যে ব্যক্তি এমন কোন কিছুকে অভিশাপ দেয় যা সে অভিশাপের যোগ্য নয়, সে অভিশাপ তার নিজের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে’ -(তিরমিজি)।
বাতাস কখনো কল্যাণকর, আবার কখনো তা পরিণত হয় শাস্তিতে, গযবে। ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি পূবালি হাওয়ার মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছি এবং আ’দ জাতি পশ্চিমা হাওয়ার মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে’ -( বোখারী ও মুসলীম)। বাতাসের আগমন বৃষ্টিকে স্বাগত জানায়। নামে প্রবল বৃষ্টি। মেঘ-বৃষ্টি-ঝড় প্রকৃতির জন্য সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসে, নিয়ে আসে অকল্যাণও। যা ক্ষতির কারণ হয়। বয়ে আনে দূর্ভিক্ষ। অনাবৃষ্টি শুধু দূর্ভিক্ষ বয়ে আনে না। অতিবৃষ্টিও দূর্ভিক্ষের কারণ হয়ে দাড়ায়। হাদীসের বাণী, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ এই নয় যে, তোমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষিত হবে না; বরং ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ হচ্ছে, তোমাদের প্রতি প্রচুর বৃষ্টি বর্ষিত হবে অথচ জমিন কোন কিছু উৎপাদন করবে না’ -(মুসলীম)। ঝড়-তুফান আর প্রবল বৃষ্টি মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার সৃষ্টি করে। সত্যিই অনেক কষ্ঠের সে মুহুর্তগুলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঝড় তুফান শুরু হলে আল্লাহর কাছে করুণার দো’আ শুরু করে দিতেন। হাদীসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কখনো ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাটুদ্বয় পেতে বসে যেতেন। আর বলতেন, হে আল্লাহ! এটাকে করুণাস্বরূপ করুন, একে শাস্তিস্বরূপ করবেন না। হে আল্লাহ! এটাকে মৃদু বাতাসে পরিণত করুন, ঝড় তুফানে পরিণত করবেন না’ -(শাফেয়ী, বায়হাকী)। তাছাড়া, প্রবল ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে তার উত্তমতার ও কল্যাণের দো’আ করতেন। হাদীসে এসেছে, ‘হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন প্রবল ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হতো, তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা ফিহা ওয়া খাইরা মা উরসিলাত বিহী, ওয়া আউযুবিকা মিন র্শারিহা ওয়া র্শারি মা ফিহা ওয়া শাররি মা উরসিলাত বিহী” (হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এর ভালো দিকটি এবং এতে যে কল্যাণ রয়েছে তা আর একে যে উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে তার ভালো দিকটি কামনা করছি। আর আমি আপনার কাছে এর মন্দ দিকটি হতে এবং এতে যে অকল্যাণ রয়েছে তা হতে ও এটা যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে তার মন্দ দিক হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।) আর যখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতো তখন তাঁর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত এবং তিনি (ভয় বিহŸল চিত্তে) একবার ঘর হতে বের হতেন আবার ঘরে প্রবেশ করতেন। একবার অগ্রসর হতেন, আবার পিছন ফিরে আসতেন। আর যখন স্বাভাবিক বৃষ্টি হতো, তাঁর চেহারা খুশিতে ভরে উঠত’ -(বোখারী ও মুসলীম)।
ঝড়ের সাথে সাথে শুরু হয় বজ্রধ্বনি আর বজ্রপাত। বজ্রধ্বনি। বিকট আওয়াজ। কতইনা ভয়াবহ। মানুষের প্রাণ যায়, আহত হয়। কষ্ঠ দূর্ভোগের শেষ নেই। ইসলাম আমাদেরকে বজ্রপাতের সময় করণীয় শিখিয়ে দিয়েছে বহু আগে। কেননা, ইসলাম তো পরিপূর্ণ জীবন বিধান। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেঘের গর্জন ও বজ্রধ্বনি শুনতে পেতেন তখন বলতেন, “আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুল্না বিগাদ্বাবিকা ওলা তুহ্লিক্না বিআ’যাবিকা, ওয়া আ’ফিনা ক্বাব্লা যালিক” (হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তোমার ক্ষোভ ও রোষের দ্বারা হত্যা করো না এবং আমাদেরকে তোমার শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করো না, বরং আমাদেরকে প্রশান্তি দান কর)’ -(আহমদ, তিরমিজি)। অন্য হাদীসে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি যখন মেঘের গর্জন শুনতে পেতেন, তখন কথোপকতন পরিত্যাগ করতেন এবং (এ আয়াত) তেলাওয়াত করতেন, ‘আমি সেই সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যার পবিত্রতা ঘোষণা করেছে মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসার সাথে এবং ফেরেশতাকুল পবিত্রতা ঘোষণা করে তাঁর ভয়ে’ ( সুরা আর রা’আদ ঃ ১৩) -(মালিক)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে যেন অকল্যাণকর সকল মেঘ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান, বজ্রধনি ও বজ্রপাত হতে রক্ষা করেন। মেঘ বৃষ্টিকে আমাদের জন্য কল্যাণকর করে দেন।
লেখক : এমফিল গবেষক
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন