মনির হোসেন হেলালী
\ শেষ কিস্তি \
বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত হজ, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদাত-বন্দেগী কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু সিয়াম পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাবনা থাকে না। ফলে সিয়ামের মাঝে ইখলাস, আন্তরিকতা বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজালও বেশি থাকে।
এছাড়াও সিয়ামের আরো অনেক ফাজীলাত রয়েছে। যেমন- দুই. সিয়াম আদায়কারী বিনা হিসাবে প্রতিদান লাভ করে থাকেন [মুসলিম : ১৫৫১]; তিন. সিয়াম ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা [মুসলিম : ১৪০০]; চার. সিয়াম জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল। পাঁচ. সিয়াম হল জান্নাত লাভের পথ। ছয়. সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম। সাত. সিয়াম ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম। আট. সিয়াম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে।
নয়. সিয়াম হল গুনাহ মাফের কারণ ও গুনাহের কাফফারা। হাদীসে এসেছে- ‘যে রমযান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ [সহীহ আলবুখারী : ২০১৪, মুসলিম : ১৮১৭]
ইহতিসাবের অর্থ হল : আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে এ দৃঢ় বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সাথে সন্তুষ্ট চিত্তে সিয়াম ও কিয়াম আদায় করা।
হাদীসে আরো এসেছে- ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুম’আ থেকে অপর জুম’আ এবং এক রমযান থেকে অপর রমযান হল মধ্যবর্তী সময়ের পাপের কাফফারা, যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেচে থাকা যায়।’ [মুসলিম : ৫৭৪]
সিয়াম ছোট পাপগুলোকে মিটিয়ে দেয় আর তাওবা করলে কবীরা গুনাহ মাফ করা হয়। কুরআস মাজীদে এসেছে- ‘তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মাঝে যা গুরুতর তা হতে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।’ [সূরা নিসা : ৩১]
এ আয়াত ও হাদীস দুটো দ্বারা প্রমাণিত হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে। যথা-
প্রথম : রমযানের সিয়াম পালন করতে হবে ঈমানের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এবং সিয়াম যে একটি ফরয ইবাদাত এর প্রতি বিশ্বাস। সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ যে সকল পুরস্কার দেবেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
দ্বিতীয় : সিয়াম পালন করতে হবে ইহতিসাবের সাথে। ইহতিসাব অর্থ : আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কারের আশা করা, তাকে সন্তুষ্ট করতেই সিয়াম পালন করা, আর সিয়ামকে বোঝা মনে না করা।
তৃতীয় : কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গুনাহ ঐ সকল পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে, অথবা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে লানত (অভিসম্পাত) বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন, শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যভিচার করা, জাদু-টোনা, অন্যায় হত্যা, মাতা-পিতার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা, বিচারের নামে অবিচার করা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি, মিথ্যা শপথ, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরদোষ চর্চা, চোগলখোরি, সত্য গোপন করা ইত্যাদি।
যে ধরনের সিয়াম এ সকল ফজীলত অর্জন করতে পারে :
যে সকল ফজীলত ও সওয়াবের কথা এতক্ষণ আলোচনা করা হল তা শুধু ঐ ব্যক্তি লাভ করবে যে নি¤েœাক্ত শর্তাবলী পালন করে সিয়াম আদায় করবে।
ক) সিয়াম একমাত্র আল্লাহর জন্য আদায় করতে হবে। মানুষকে দেখানো বা শোনানো অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জন কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতির নিয়তে সিয়াম আদায় করবে না।
খ) সিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের সুন্নাত অনুসরণ করতে হবে। সাহরী, ইফতার, তারাবীহসহ সকল বিষয় রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী আদায় করতে হবে।
গ) শুধু খাওয়া-দাওয়া ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকলে যথেষ্ট হবে না। মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, ধোঁকাবাজি, ঝগড়া-বিবাদসহ সকল প্রকার অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। মুখ যেমন খাবার থেকে বিরত থাকে, তেমনিভাবে চোখ বিরত থাকবে অন্যায় দৃষ্টি থেকে, কান বিরত থাকবে অনর্থক কথা ও গান-বাজনা শোনা থেকে, পা বিরত থাকবে অন্যায়-অসৎ পথে চলা থেকে।
সিয়াম পালনের মহান উদ্দেশ্য এটাই যে, সিয়াম পালনকারী শরীয়তের দৃষ্টিতে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত আচার-আচরণ থেকে নিজেকে হিফাযত করবে। অতএব সিয়াম হল, সকল ভাল বিষয় অর্জন ও অন্যায়-গর্হিত কাজ ও কথা বর্জন অনুশীলনের একটি শিক্ষালয়।
তাইতো দেখা যায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিয়েছেন- ‘যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ [বুখারী : ৬০৫৭]
সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং উপকারিতা : সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কল্যাণ ও উপকারিতা ব্যাপক। এখানে আমরা মৌলিক কয়েকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
১) তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি : এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সিয়ামের লক্ষ্য হল মানুষ তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করবে। তিনি বলেন- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ [সূরা আলবাকারা : ১৮৩]
তাকওয়া হল আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করা, আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এটা করা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভ ও তাঁর শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। সিয়াম পালনকারী আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে যখন বৈধ পানাহার ও যৌনাচার বর্জন করতে পারে তখন সে অবশ্যই অবৈধ আচার-আচরণ, কথা ও কাজ এবং ভোগ-বিলাস থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
২) শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা : শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় প্রবেশ ও চলাচল করতে পারে। আর কু-প্রবৃত্তি যদি যখন যা ইচ্ছা তা করতে থাকে তখন সে উদ্ধত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে এবং সে তার আরো চাহিদা মিটানোর জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুধা ও পিপাসা দিয়ে শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সাহায্যে শয়তান ও কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এ কারণে কু-প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম নামক চিকিৎসা দিয়েছিলেন। কেননা নফ্সে আম্মারা বা কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সকল প্রকারের পাপাচারে লিপ্ত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন