শাইখ বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসি
\ এক \
রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্যে হেদায়াত এবং সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। সূরা বাক্বারা, ১৮৫
পবিত্র মাহে রমযানের রোযা ইসলামের পাঁচটি রুরনের মধ্যে অন্যতম এবং ইসলামের মৌলিক নিদর্শনগুলোর মাঝেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রমযান শরীফের এই রোযা মহান আল্লাহ তায়ালার রুবুবিয়াতকে (প্রভুত্বকে), মানুষের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের দায়িত্ববোধকে, নিজের নফসের পরিশোধন এবং আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের মত অনেক বিষয়কে অনুধাবন করাতে সাহায্য করে। এরূপ অসংখ্য হিকমতের মধ্য থেকে নি¤েœ নয়টির বর্ণনা করা হলো।
প্রথম হিকমত
রমযানের রোযার মাঝে মহান আল্লাহ তায়ালার রুবুবিয়াত সম্পর্কিত অসংখ্য হিকমত রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে একটি হলো মহান আল্লাহ তায়ালা ভ‚পৃষ্ঠকে নিয়ামতের দস্তরখানা হিসেবে সৃষ্টি করে বিভিন্ন রকমের নিয়ামত দ্বারা এই দস্তরখানাকে সুসজ্জিত করেছেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা মানুষের কল্পনাতীত উপায়ে এই নিয়ামতগুলো সরবরাহ করে তার পরিপূর্ণ রুবুবিয়াত, রাহমানিয়াত ও রাহিমিয়্যাতকে উপস্থাপন করছেন। মানুষ গাফলতে নিমজ্জিত হওয়ায় এবং বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার কারণে ওইসব হাকিকতকে পরিপূর্ণরূপে দেখতে পায় না, দেখলেও ভুলে থাকে। কিন্তু পবিত্র রমযানের শুরুর সাথে সাথেই ঈমানদারগণ সুশৃংখল একটি সৈন্য বাহিনীতে পরিণত হয়। চিরন্তন সুলতানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে ইবাদতের (দাসত্বের) নিদর্শন স্বরূপ সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারের অনুমতির অপেক্ষায় থাকে। এভাবে মহান আল্লাহর সীমাহীন মমতা, পরক্রমশীলতা ও সামাগ্রিক রাহমানিয়াতের জন্য মুমিনগণ ব্যাপক, বৃহৎ ও সুশৃংখল ইবাদতের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। এমন মহিমান্বিত ইবাদত ও মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে যারা অংশগ্রহণ করে নাতারা কি মানুষ হওয়ার যোগ্যতা রাখে?
দ্বিতীয় হিকমত
পবিত্র রমযানের রোযার মাঝে আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় সম্পর্কিত অসংখ্য হিকমত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে থেকে একটি হল,
বাদশাহর রন্ধনশালা থেকে খাদেম যে খাবার পরিবেশন করে তার একটি নির্দিষ্ট মূল্য রয়েছে। এখন কেউ যদি ঐ মহামূল্যবান রাজকীয় খাবারকে মূল্যহীন মনে করে এবং প্রকৃত নিয়ামতদাতাকে অস্বীকার করে তবে তা ¯্রফে বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য এই পৃথিবীকে নানা প্রকারের নিয়ামত দিয়ে সুসজ্জিত করেছেন। বিনিময়ে তিনি মানুষের কাছ থেকে শুকরিয়া প্রত্যাশা করছেন। এ নিয়ামতগুলো আমাদের কাছে যে সকল বাহ্যিক কার্যকারণ ও উসিলার মাধ্যমে আসে এবং যারা রূপকার্থে এগুলোর মালিক তারা ঐ পরিবেশকের মতই খাদেমতুল্য। আমরা এই পরিবেশকদেরকে মূল্য দেই এবং তাদের কাছে কৃতজ্ঞ হই! এমনকি তাদের প্রাপ্যের চেয়েও অনেক বেশি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানাই। অথচ প্রকৃত নিয়ামতদাতা হিসেবে আল্লাহ এই মাধ্যমগুলোর চেয়ে শতগুণ বেশি শুকরিয়ার দাবিদার। তাই আমাদের উচিত আল্লাহ তায়ালার সর্বোচ্চ শুকরিয়া আদায় করা। আর এ শুকরিয়া আদায়ের উপায় হল নিয়ামতগুলো যে সরাসরি তাঁর কাছ থেকে আসে তা অনুধাবন করা, এগুলোর মূল্যকে উপলব্ধি করা এবং নিজেদের জন্য এগুলোর রোযা হলো প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করা। পবিত্র রমযান মাসের রোযা হল হাকিকি, খালিস, মহান এবং সার্বিক এক শুকরিয়ার চাবিকাঠি। কারণ অন্যান্য সময়ে অধিকাংশ মানুষ বাধ্য না হওয়ার কারণে প্রকৃত ক্ষুধা অনুভব করে না। একারণে অধিকাংশ নিয়ামতের মূল্য অনুধাবন করতে পারে না। ক্ষুধাহীন কোন ব্যক্তি, বিশেষ করে সে যদি ধনী হয় তবে এক টুকরো শুকনো রুটির মাঝে যে নিয়ামত আছে তা বুঝতে পারে না। অপরদিকে ইফতারের সময় একজন মুমিনের দৃষ্টিতে, ঐ শুকনো রুটি যে অতি মূল্যবান এক ইলাহি নেয়ামত তা তার স্বাদ আস্বাদন শক্তি সাক্ষ্য দেয়। তাই পবিত্র রমযানে ঐ নিয়ামতের গুরুত্বগুলো বুঝতে পারার কারণে বাদশাহ-ফকির নির্বিশেষে সকলের মাঝেই এক কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
দিনের বেলায় সকলেই সন্তুষ্টির সাথে পানাহার থেকে দূরে থাকে আর বলে, “এই নেয়ামতগুলোর প্রকৃত মালিক আমি নই। আমি নিজের ইচ্ছানুযায়ী এগুলো খেতে পারি না। এগুলো অন্যের সম্পদ ও নিয়ামত হওয়ায় তার আদেশের অপেক্ষায় আছি।” এভাবে নিয়ামতের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং শুকরিয়া আদায় করে। এ কারণে বিভিন্ন দিকে থেকে রমযান মাসের রোযা, প্রকৃত মানবিক দায়িত্ব তথা শুকরিয়া আদায়ের চাবিকাঠি হিসেবে পরিগণিত হয়।
তৃতীয় হিকমত
মানুষের সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রেও রমযানের রোযার অসংখ্য হিকমত রয়েছে। এগুলো থেকে একটি হলো,
জীবন ধারণের দিক থেকে মানুষকে বিভিন্ন স্তরে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বিভিন্নতার কারণে মহান আল্লাহ তায়ালা ধনীদেরকে দরিদ্রদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহŸান জানাচ্ছেন। ধনীরা রমযানের সময় অভুক্ত থাকার মাধ্যমে দরিদ্রদের দারিদ্রাবস্থা ও ক্ষুধার তাড়না পরিপূর্ণরূপে অনুভব করতে পারে। এ কারণে তাদের মাঝে দরিদ্রদের জন্য করুণার উদ্রেক হয়। যদি রোযা না থাকত, নফসের পূজারী অধিকাংশ ধনীরা ক্ষুধার তাড়না ও দারিদ্রতার যাতনা বুঝতে পারত না। একইভাবে গরীবরা যে মায়া-মমতার প্রতি কতটা মুখাপেক্ষী তাওঅনুভব করতে পারত না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, মানবপ্রকৃতির মাঝে সমগোত্রীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা প্রকৃত শুকরিয়ার অন্যতম ভিত্তি। প্রত্যেকের পক্ষেই, নিজের চেয়েও অধিক অভাবী কাউকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভব; এক্ষেত্রে সে ঐ অভাবীর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে বাধ্য। আর মহমর্মিতার কারণেই মানুষ একে অপরের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের দ্বারা সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়। যদি নফসকে ক্ষুধার যাতনা অনুভবে বাধ্য না করা হয় তবে সে সহযোগিতা করতে পারে না; করলেও তা পরিপূর্ণ হয় না। কেননা সে তার নিজ সত্তায় ঐ অবস্থা প্রকৃতভাবে অনুভব করতে পারে না।
চতুর্থ হিকমত
মাহে রমযানের রোযার মধ্যে নফসের তারবিয়ার (আত্মশুদ্ধির) জন্য বিদ্যমান অনেক হিকমতের মধ্য থেকে একটি হলো, নফস স্বাধীন ও মুক্ত থাকতে চায় এবং নিজেকে তাই মনে করে। এমনকি নিজের মাঝে কল্পিত এক রুবুবিয়াত দেখতে চায় ও যথেচ্ছা জীবন-যাপন করার আকাক্সক্ষা পোষণ করে- যা তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। অসংখ্য নিয়ামতের দ্বারা যে সে প্রতিপালিত হচ্ছে কখনো তা ভাবতে চায় না। বিশেষ করে দুনিয়াতে যদি তার সম্পদ ওক্ষমতা থাকে এবং গাফলতও যদি তাকে পেয়ে বসে তবে চুরি-ডাকাতি করে সমস্ত ইলাহী নিয়ামতকে পশুর মত গ্রাস করে ফেলে।
পবিত্র রমযানে, সবচেয়ে ধনী থেকে অতি ফকির পর্যন্ত সকলের নফসই উপলব্ধি করে যে, সে নিজে মালিক নয় বরং অন্যের মালিকানাধীন, স্বাধীন নয় বরং অন্যের বান্দা। পানি পানের মত অতি সাধারণ ও সহজ কোন কাজও অনুমতি ছাড়া করতে পারে না। এভাবে তার মাঝের ঐ কল্পিত রুবুবিয়াতের ইতি ঘটে; পরিবর্তে উবুদিয়াতের প্রকাশ পায়, প্রকৃত দায়িত্ব তথা শুকরিয়া আদায়ে মগ্ন হয়।
পঞ্চম হিকমত
আখলাকের পরিচ্ছন্নতা ও বিদ্রোহী আচরণ থেকে মুক্তির জন্য রযমানের রোযার মাঝে বহু হিকমত রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, মানুষের নফস গাফলতের কারণে নিজেকে ভুলে যায়। নিজের প্রকৃতিতে বিদ্যমান সীমাহীন অক্ষমতা, চরম দরিদ্রতা আর অতি মাত্রার ত্রæটি-বিচ্যুটিগুলো সে দেখতে পায় না এবং দেখতে চায়ও না। নিজে যে কতটা দুর্বল, বিপদ-আপদের দ্বারা পরিবেষ্টিত, ধ্বংসের সম্মুখীন এবং দ্রæত পচনশীল হাড়-গোশতের তৈরি এক দেহের অধিকারী তা চিন্তা করে না; বরং মনে করে তার দেহটি ইস্পাতের তৈরি যা কখনও ধ্বংস হওয়ার নয়। চিরকালই বেঁচে থাকবে ভেবে দুনিয়াকে আঁকড়ে ধরে।
আল্লাহ মালিক
তিনিই মহান আল্লাহ যিনি রাতের বেলা তোমাকে মৃত (লোকের মত) করে ফেলেন, দিনের বেলা তোমরা যা কিছু করে বেড়াও, তা-ও তিনি খুব ভাল করে জানেন, পরিশেষে সেখানে তিনি (মৃতসম অবস্থা থেকে) আবার (জীবনের অবস্থায়) ফিরিয়ে আনেন, যাতে করে তোমাদের নির্দিষ্ট আয়ু পূর্ণ হয়, (অতঃপর) তার দিকেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন হবে, তখন তিনি তোমাদের বলে দেবেন তোমরা কী কী কাজ করেছিলে।-সূরা আলআনআম : আয়াত ৬০
শাহাদাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদি.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘দুটি চোখকে কোন দিন দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না। যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে; যে চোখ আল্লাহর পথে সারারাত পাহারা দিয়েছে।’
-তিরমিজি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন