মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
\ এক \
ইসলাম মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল পরিপূর্ণ একটি জীবনবিধান। এর বিধানবলি যেমন সহজ সাবলীল, তেমনি তা সুষ্ঠূ রুচি সম্পন্ন বটে। এ ব্যবস্থা মানবজাতির দেহ ও মনের সুস্থ বিকাশ সাধনে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। যারই প্রেক্ষিতে মানুষের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি চিত্ত বিনোদনের ব্যাপারেও সঠিক ও যথার্থ নির্দেশনা পেশ করেছে। অত্র প্রবন্ধে বিনোদনের পরিচয়, এ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, ইসলাম প্রদত্ত বিনোদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ঠ্য ও মূলনীতি এর সীমারেখা এবং রাসূল স. ও সাহাবা কিরাম রা. এর সময়কাল বিনোদনের বিভিন্ন ধরণ পদ্ধতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি মূলত বর্ণনা ও বিশ্লেষন মূলক ধারায় সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি থেকে ইসলাম অনুমোদিত বিনোদনের বিবরণ জানার পাশাপাশি ও সুস্থ ও রুচিশীল বিনোদনমূলক কর্মকান্ড চর্চা, এবং বিনোদনের নামে সমাজে প্রচলিত নানা অশ্লীল ও অনৈতিক কাজকর্ম অণুপ্রেরণা পাওয়া যাবে।
ইসলাম মানবজাতির জন্যে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সর্বজনীন ব্যবস্থার নাম। জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের রয়েছে ইসলাম প্রদত্ত সুন্দর, শাশ্বত কল্যানময় পথ নির্দেশনা। যেগুলো একদিকে যেমন মানবকল্যাণধর্মী, অন্যদিকে তা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও চাহিদার অনুকূলে। এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনিভাবে তা তার আধ্যাত্বিক জীবনকে ও পরিশুদ্ধ করে তোলে। এ অমোঘ বিধান তার জীবনকে যাবতীয় অশুচি, অসুন্দর ও অশালীন কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে পরিচ্ছন্ন, শালীন ও নির্মল করে তোলে। তবে ইসরাম মানব জীবনের সুখ দু:খ আনন্দ নিরানন্দ সর্বক্ষেত্রে একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। মানুষ দুঃখ যন্ত্রণা ও নানা প্রতিকূলতায় যেমন মানসিক চাপ অনুভব করে, তেমনি ভাবে নানা উৎসব অনুষ্ঠাণে একটু খুশি ও আমোদিত হয়ে মানসিক চাপমুক্ত হয়। দুঃখ দুর্দশায় ব্যথিত হওয়া কিংবা কারো মৃত্যুতে শোকাতুর হওয়া মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। ইসলাম এটিকে অস্বীকার করে না; বরং নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চললে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি বৈধ। অন্যদিকে খুশি বা আনন্দ প্রকাশে ও ইসলাম সীমা ঠিক করে দিয়েছে, যা মেনে চলা একজন মুমিনের ঈমানের দাবি। এক কথায়, মানব জীবনের আদি অন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই সুন্দর নির্দেশনা ইসলামে রয়েছে। এ হিসেবে মানুষের চিত্ত বিনোদনের বিষয়টি ও ইসলামে উপেক্ষিত নয়; বরং বিনোদন ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলাম মানব জাতির জন্যে খুবই সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ রীতিনীতি শিক্ষা দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে সুস্থ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনোদনের ব্যাপারে আমাদের সমাজে পরস্পর বিরোধী দুটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন এ যুক্তিতে যে, এতে অহেতুক মানুষের মূল্যবান সময়ের অপচয় হয় এবং তা মানুষের মাঝে নানারকম অন্যায় ও অশালীন প্রবণতা সৃষ্টি করে, ক্ষেত্রবিশেষ তা মানব চরিত্রকে কলুষিত করে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায়। এ কারণে বিনোদন মানুষের জন্যই কোনো মতেই উপকারী কিংবা প্রয়োজনীয়তা হতে পারে না। বিপরীত পক্ষে দ্বিতীয় ধারণা মতেই বিনোদনমূলক কর্মকা মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় বিনোদনমূলক উপায় উকরণ গ্রহণ ও চর্চা বড়ই উপকারী, অনেক সময় তা মানুষের সামগ্রিক সুস্থতা ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় আবশ্যিক হয়ে পড়ে। বর্তমানে বিনোদনের ব্যাপারে অনেক বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্গন পরিলক্ষিত হয়। বিনোদনের নামে অনেক ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয়, যা একদিকে যেমন রীতি নৈতিকতা পরিপন্থী, তেমনিভাবে তা ইসলামের বিধি বিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিকও। এতে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নানা অনাচার ও অশ্লীল কর্মকান্ডের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। সমাজে বহুরকম অরাজকতা ও আশালীনতার সয়লাব বয়ে যায়। তার কুপ্রবাবে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও লজ্জাবোধ সমাজ থেকে লোপ পায়। সাথে সাথে তা সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে স্বস্তি, শান্তি ও নির্মলতার পরিবর্তে নানা অশান্তি, অস্তিরতা ও অবিশ্বাসের বীজ বপিত হয়। বিনোদনের নামে এ সব অনৈতিক কাজের চর্চার ফলে পারিবারিক জীবনে নেমে আসে আস্থাহীনতা ও অশান্তির কালোছায়া। ছিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক বন্ধন। যুব সমাজ হযে উঠে মেধাহীন ও জ্ঞান চর্চার মহান ব্রত থেকে বিচ্যূত। এ কারণে একজন মুসলিম ব্যক্তির উচিত, কোন ধরনের বিনোদন ব্যবস্থা তার জীবনকে সুন্দর, শালীন ও শান্তিময় করবে, দূর করবে মনের অশান্তি, অস্থিরতা এবং জীবনকে করে তোলবে গতিময় তা যথার্থভাবে অবগত হওয়া, পক্ষান্তরে কোন ধরণের বিনোদন চর্চায় তার জীবনে নেমে আসবে অশান্তির অমানিমা তাও অবগত হওয়া উচিত। এক কথায় বিনোদানের ব্যাপারে ইসলাম উপস্থাপিত দিক নির্দেশনা ও বিধি বিধান মাধ্যমেই সম্ভব অসুস্থ ও রুচিহীন বিনোদনের করালগ্রাস থেকে নিজেকে এবং গোটা সমাজকে রক্ষা করা। সাতে সাথে সুস্থ ধারার বিনোদলমূলক কর্মকান্ড চর্চার মাধ্যমে জীবনের অবসাদ, ক্লান্তি ও হতাশা বিদূরিত করে জীবনকে সুখময় করা যায়। এর মাধ্যমে মানুষ সর্বপ্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সজাগ ও সচেতন থাকতে পারে। সর্বোপরি ইসলাম প্রদত্ত বিনোদনের উপায়গুলো চর্চার মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহ প্রদত্ত জীবনকে সুস্থ ও সবল রেখে তাঁরই ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে। বব্যমাণ প্রবন্ধে বিনোদনের পরিচয়, মানুষের জীবনের বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা, সীমারেখা ও মূলনীতি প্রভূতি বিষয় তোলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
অভিধানিক দৃষ্টিতে বিনোদন এর বিভিন্ন অর্থ পরিলক্ষিত হয়। যেমন, সানন্দে যাপন, কষ্ট অপনোদন, আমোদিত কারণ, তুষ্টি সাধন ইত্যাদি। ইংরেজীতে বিনোদন বুঝাতে একাধিক শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন উরাবৎঃরড়হ [চিত্ত বিনোদন], জবপৎবধঃরড়হ [বিশ্রাম বিনোদন], ঝঢ়ড়ৎঃ [ক্রীড়া কৌতুক] আরবীতে বিনোদনকে তাফরীহ বলা হয়। এর মূল অর্থ আনন্দ দান। মানুষ জীবন পরিক্রমায় নানাবিধ কাজ ও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ফলে তাকে একটু বিশ্রাম বা আনন্দ উপভোগ করতে হয়। এভাবে কঠোর পরিশ্রমান্তে আত্মাকে সতেজকরণ ও নবশক্তি দানই হলো বিনোদন। আরবী ভাষায় বিনোদন বুঝাতে তারবীহ শব্দটি ও ব্যবহৃত হয়। এটি রাওহোন শব্দ থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো আত্ম। সুতরাং বলা যায়, বিনোদন আত্মার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়, যার মাধ্যমে তৈরি হবে আত্মার প্রশান্তি, মনের সতেজতা, হ্রদয়ে কর্মোদ্দীপনা, যা মানব মনের ক্লান্তি ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করে, অবসন্ন মনকে প্রফুল্ল ও আমোদিত করে।
গবেষকগণ বিনোদনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো: “যা মানব মনকে ক্লান্তিমুক্ত করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার মাধ্যমে মনকে প্রফুল্ল ও আমোদিত করে।” “বিনোদন হলো, ব্যক্তি অবসর সময়ে চর্চা করে এমন উপভাগ্য ইচ্ছামূরক কর্মতৎপরতা”। “বিনোদন হলো, খেলাধুলা ও আনন্দ উপভোগের বৈধ উপায়ে আত্মাকে আনন্দিত করা ও মনে প্রাণচঞ্চল সৃষ্টি করা। “মানুষের অবসর সময়কে এমন সুন্দরভাবে কাজে লাগানো, যা তার মাঝে শারীরিক ও চিন্তাগত নতুন শক্তি সঞ্চার এবং প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।” উপর্যুক্ত ৩য় সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে, বিনোদনের যে সব ব্যবস্থা বা উপায় অবলম্বন বৈধ নয়, তা বিনোদন হতে পারে না। যেমন, সেসব বিনোদনমূলক কর্মকা- যা ব্যক্তির নিজের বা সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যা দ্বারা নিনোদনের যে আসল উদ্দেশ্য তা অর্জিত হয় না। অতএব, যে সব কর্মকান্ডে মনের অস্থিরতা বাড়ে,মানুষ হ্রদয়হীন হয় অথবা দায়িত্ব পালনের অনাগ্রহী হয়ে পড়ে কিংবা কর্মস্পৃহা হারিয়ে নেতিবাচক চিন্তায় জড়িয়ে পড়ে, তা বিনোদন হতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন