মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
\ দুই \
বিনোদন মানব জীবনের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। তা মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবি। এতে ব্যক্তির কাজে গতি ফিরে আসে, মানসিক চাপ কমে এবং জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে। মানুষ কাজের ফাঁকে ফাঁকে যদি একটু আনন্দ বা বিনোদন লাভ করতে পারে, তাহলে তার পুরো জীবনটাই আনন্দময় হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে মানুষ যখন কাজের ভারে নানা ভাবে জর্জরিত হয়ে অশান্ত ও অস্থির হয়ে উঠে, তখন তা তার জীবনকে দু:খ ভারাক্রান্ত করে তোলে। তাই অবসর সময়ে নির্ধারিত সীমারেখা মেনে বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের চর্চা করা মানুষের জন্য খুবই দরকার। এক কথায়, মানুষের প্রশান্ত ও আনন্দ আহ্ল্লাদপূর্ণ জীবনযাপনে সুস্থ বিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য জীবনের চেয়ে মানুষের রয়েছে স্বতন্ত বৈশিষ্ট্য। আক্বল ও মেধা মানুষকে করেছে অনন্য। বুদ্ধি ও চেতনায়, রুচি ও বৈশিষ্ঠ্য অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানব জাতরি শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্টত্ব দান করেছি। মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলা যে আক্বল তথা বোধশক্তি দান করেছেন, সে মেধা ও বিবেক বুদ্ধিকে বিকাশ করতে হলে প্রয়োজন সুস্থ রুচিসম্পন্ন ও মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বিনোদন। সুন্দর বিনোদান ব্যবস্থা মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সুস্থ ধারার বিনোদন মানুষের আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক চাহিদার মাঝে সমন্বয় সাধন করে। মানুষ যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল ও সুস্থ না হয়, তাহলে তার জীবনে নানা অসংগতি ও বৈপরীত্য দেখা দিতে পারে। এ কারণেই মানব জীবনে বিনোদন প্রয়োজন, যা তার কর্মময় জীবনকে গতিশীল রাখবে। সাথে সাথে তা এনে দিবে আত্মার প্রশান্তি, বিবেকের সুস্থতা ও সচলতা এবং শারীরিক নিরাময়তা। একজন মুমিন ব্যক্তি যেন তার জীবনকে ভারসাম্য পূর্ণ করে ঢেলে সাজায়, এ জন্য রাসূলুল্লাহ স. মানুসকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শনা দিয়েছেন। রাসূল স. তাঁর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইননিল আছ রা.কে লক্ষ্য করে বললেন: নিশ্চয় তোমার শরীরের জন্য তোমার ওপর হক আছে, তোমার আত্মার জন্য তোর ওপর হক আছে তার স্ত্রীর জন্য তোমার ওপর হক আছে।
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, পরিবার পরিজনের প্রতি যেমন ব্যক্তির দায়দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নিজ দেহ ও আত্মার প্রতি ও কিছু কর্তব্য তার ওপর অর্পিত আছে। দেহের যতœ নেওয়া অনাকাঙ্কিত ক্ষতি থেকে অঙ্গ প্রতঙ্গকে রক্ষা করা, শরীরকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেওয়া এসব কিছুই কিছুই শরীরের হক হিসাবে গণ্য। অন্যদিকে আত্মাকে আনন্দ ও প্রফুল্ল রাখা, অহেতুক দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত রাখা আত্মার হকের মধ্যে পড়ে। কারণ, দুঃখ ও বিষন্নতা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ব্যক্তিকে গতিহীন করে, নানাবিধ হতাশা ও আশঙ্কায় জীনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তাই প্রয়োজন সুস্থ ও বিনোদনের, যা মানুষের মাঝে প্রসন্নতা এনে দেবে। এ ক্ষেত্রে রাসূল স. এর শিখানো নিম্নের দুআটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সাইয়িদুনা আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত রাসূল স, ইরশাদ করেন- হে আল্লাহ দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় কামনা করছি।
সুতরাং সুস্থ ও নির্মল বিনোদন মানুষের জন্য অত্যবশ্যক, যে বিনোদন ব্যবস্থায় থাকবে খুশি ও আনন্দ প্রকাশে শালীনতা, আনন্দ আহ্লাদ ও খুশি কিংবা রসাত্মক কথামালার মাধ্যমে মানুষের অবসর সময় উপভোগ ও উদযাপনের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা। সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে মানুষের একগুয়েমি ভাব দূর হয় এবং তা মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন উদার ব্যক্তিরূপে গড়ে তুলে। সুস্থ বিনোদন চর্চার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনায় ইতিবাচক দিক সৃষ্টি হয়, হরেক রকম অশুভ ও আশালীন কাজের প্রবণতা দূর হয়। এককথায় মানুষের কর্মময় এ জীবনে আত্মিক সজীবতার জন্য বিশ্রাম ও বিনোদন খুবই প্রয়োজন। আজকাল মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্ত বিনোদনকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আনন্দ ও চিত্ত বিনোদনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, চিত্ত বিনোদন, হাসি খুশি এমন এক অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া, যার ফলে মুখের ১৫টি মাংসপেশি একই সময়ে সংকুচিত হয় এবং দ্রæত শ্বাস প্রশ্বাস ঘটে। এছাড়াও মানুষ যখন হাসি ও প্রফুল্লতার মধ্যে সময় অতিবাহিত করে, তখন শরীরের রক্তপ্রবাহ দ্রæত সঞ্চালিত হয়। যার কারণে রক্তে এড্রেনালিন বেড়ে যায়। ফলে মানুষ সজীবনতা ও আনন্দ অনুভব করে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে, মানুষ মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও আবেগের ভারসাম্যহীনতার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য বিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
বিনোদন বা আনন্দ উপভোগ মানুষ নানারূপ ও ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে করে থাকে। কখনো তা হয় ক্রীড়া কৌতুকে। আবার কখনো হয় অন্য রূপে। মানুষের স্বভাব প্রকৃতি সকলেই একই রকম নয়। নানা স্বাদ ও রুচি মানুষের মাঝে বিরাজ করে। মনের আনন্দ ও প্রশান্তি লাভ একটি আপেক্ষিক বিষয়। কেউ কোন জিনিস দেখে কিংবা সম্পাদন করে আনন্দ লাভ করে। আবার কারো কাছে হতে পারে একই জিনিষটি দুঃখ বেদনার। সুস্থ রুচিবোধের অভাবে মানুষ অনৈতিক কাজেও আনন্দ উপভোগ করলে তা কিন্তু বিনোদন বরং; তা হলো বিনোদনের নামে এক প্রকার নৈরাজ্য। বিনোদনের বহুবিধ মাধ্যম এমন রয়েছে, যা আত্মার প্রশান্তি ও মনের স্থিরতা বয়ে আনে না; বরং তা মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে মানুষকে মানসিকভাবে অস্তির করে তোলে। সাথে সাথে দেহ মনও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতে মানুষ হয়ে পড়ে নীতিহীন। জীবনে নেমে আসে নান রক্ষম অবক্ষয় । প্রাশান্তির পরিবর্তে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এ রকম কর্মকান্ড কোন মতেই বিনোদন হতে পারে না। বিনোদন হবে এমন যা মনকে প্রফুল্ল করে অন্তরে প্রশান্তি ও স্থিরতা ডেকে আনে। মানুষ জন্মের পর থেকেই আনন্দপ্রিয়। আনন্দময় জীবন লাভ তার স্বভাবের দাবি। মানুষ তারুণ্যে পদার্পণের সাথে সাথে আনন্দ উপভোগ বা বিনোদন যাপনের আগ্রহ বেড়ে যায়। বিনোদনের ধরন প্রকৃতি মানুষের রুচি, পরিবেশ ঐতিহ্য ও চিন্তা চেতনার আলোকে বিকশিত হয়। পরিবেশ দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, (হে রাসূল) আপনি বলে দিন, প্রত্যেকই নিজ রীতি অনুযায়ী কাজ করে। অত:পর আপনার পালনকর্তা বিশেষরূপে জানেন যে, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভূল পথে আছে।
এখানে শাকিলতুন শব্দের ব্যাখ্যায় স্বভাব, অভ্যাস, প্রকৃতি, নিয়ত, রীতি ইত্যাদি বিভিন্ন উক্ত বর্ণিত রয়েছে। সবগুলোর সারমর্ম পরিবেশ। অভ্যাস, প্রথা ও প্রচলনের দিক দিয়ে প্রত্যেক মানুষের একটি অভ্যাস ও মানসিকতা গড়ে উঠে। এ অভ্যাস ও মানসিকতা অনুযায়ী তার কাজ কর্ম হয়ে থাকে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষকে সর্তক করেছেন যে, মন্দ পরিবেশ মন্দ সংসর্গ ও মন্দ অভ্যাস থেকে বিরত থাকা দরকার। মানব জাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার অবারিত করুণা ও দয়ায় মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়ার গৌরব লাভ করেছে। এ হিসেবে মানুষের গতিবিধি অপরাপর কর্মকান্ড, আনন্দ আহ্লাদ এমন হওয়া উচিত, যা তার মর্যাদার সাথে সংঙ্গতিপূর্ণ। বিনোদন হবে শোভন, মনোহর ও সুস্থ রুচিসম্পন্ন এবং নৈতিকতার সীমারেখা মেনে শালীনতা বজায় রেখে। শুধু তাই নয় বিনোদনে চারিত্রিক মূল্যবোধ ও অটুট রাখা আবশ্যক। কারণ, মানুষের কাজকর্ম ও আনন্দ উপভোগ যদি নৈতিকতা না থাকে বরং চারিত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, তাহলে মানুষের সব আয়োজন পাশবিকতার রূপ লাভ করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি ইরশাদ করেন- শপথ প্রাণের এবং তিনি যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম জ্ঞান দান করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন