সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে বিনোদনের শিষ্টাচার

| প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
\ চার \
যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধন্ত গ্রহণে সন্দেহপ্রবন হয়ে উঠে। তাই মানুষের স্বভাবজাত মনের সতেজতা রক্ষা করতে ইসলাম চিত্ত বিনোদনের ওপর গুরূপ্ত দিয়ে থাকে। সাইয়িদুনা আল’ী রা. এর একটি উক্তি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, নিশ্চয় অন্তরত সমূহের কামনা বাসনা, উৎসাহ উদ্দীপনা এবং হতাশা ও পিছটান রয়েছে। সুতরাং অন্তরের চাহিদা ও উৎসাহ ঠিক রেখে চলো। কারণ, মনকে যে কোনো বিষয়ে বাধ্য কররে তা অব্যবস্থিত হয়ে পড়ে। নিম্নে আমরা বিনোদনের গুরুত্ব বিষয়ক মুসলিত মনীষীগণের কয়েকটি উক্ত উল্লেখ করছি।
সাইয়িদুনা আলী. রা. বলেন: তোমরা আত্মাসমূহকে প্রফুল্লতা দাও এবং তার জন্যে প্রজ্ঞাপূর্ণ চমৎকার মজার বিষয় তালাশ করো, কারণ দেহের মতো আত্মা ও বিরক্ত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিশিষ্ট সাহাবী উসামাম ইবনু যায়িদ রা. আল্লাহ তাআলার যিকর এর মাধ্যমে অস্তির আত্ময় প্রশান্তি আনতে বলেছেন। তিনি বলেন: আত্মগুলোকে আনন্দ দাও যিকর এর মাধ্যমে। বিশিষ্ট তাবিয়ী আল হাসান আল বাসরী রাহ. বলেন, এই অন্তকরণসমূহ জীবন্ত থাকে, আবার নির্জীবও হয়ে যায়। আত্মা যতখন জীবন্ত থাকে, তখন তুমি একে ফরয ইবাদতের সাথে সাথে নফল বন্দেগীতেও নিয়োজিত রাখো। আত্মার নির্জীব হয়ে গেলে তুমি শুধু ফরয ইবাদতে একে নিয়োজিত করো। বিখ্যাত মুহাদ্দিস শিহাব আয যুহ্রী রহ. বলেন: কোনো এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ স. এর সাহাবীদের সাথে উঠাবাস করতেন এবং তিনি তাঁদের সাথে কথাবার্তা তাদের পারস্পরিক কথাবার্তা যখন বেশি হয়ে যেতো এবং কথা যখন তাদের কাছে ভারী হয়ে উঠত তখন তিনি বলতেন, নিশ্চয় কানসমূহ কথা শুনতে অনীহা দেখাচ্ছে আর অন্তরগুলো বিতৃষ্ণা ভাব দেখাচ্ছে। অতএব, তোমরা তোমাদের নানা রকম কবিতা ও কথামালা উপস্থাপন করো।
উপর্যুক্ত মুসলিম পন্ডিতগনের উক্তির মাধ্যমে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, চিত্ত বিনোদন ইসলামের দৃষ্টিতে উপেক্ষিত নয়; বরং ইসলাম একে উৎসাহিত করেছে। কারণ, এটি মানুষের স্বাভাবিক দাবী। কাজের পর একটু বিশ্রাম বা অবকাশ যাপন দেহ মনের স্বাভাববিক চাহিদা। মানুষের কাজের গতি ও কর্মোদ্দীপনা বাড়াতে এর কোন বিকল্প নেই। ইমাম কাযিম রা. মানুষের সময়কে চারভাগে ভাগ করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা চেষ্টা করো, যেন তোমাদের সময়কাল চার অংশে বিভক্ত হয়। এক অংশেকে কেবলমাত্র মহান আল্লাহর সাথে নির্ভৃতে সম্পর্ক গড়ে তোলে তার ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকবে, আরেক অংশ তোমাদের জীবনোপকরণ অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট রাখবে, আরেক অংশ তোমাদের ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাতের জন্য বরাদ্দ রাখবে, চতুর্থ সময়ের একটি অংশ এমনভাবে নির্ধারিত রাখবে, যাতে তোমাদের বৈধ পন্থায় আনন্দ খুশি ও মজা করে সময় কাটাতে পার। সময়ের এ অংশটির মাধ্যমেই তোমরা অপর তিনটি অংশের দায়িত্বগুলো পালন করতে শক্তি সঞ্চয় করবে। মানুষের জীবনটাই আল্লাহ প্রদত্ত এক বড় নিয়ামত। দেহ ও মনের সুস্থতা হলো এক জীবনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম শর্ত। শরীয়তসম্মত পন্থায় চিত্ত বিনোদন মানুষকে ইবাদত বন্দেগী কাজকর্ম ও সামগ্রিক উৎপাদনে সক্ষম করে তোলে। সাথে সাথে এটি যুবসমাজকে স্থায়ী কর্মমুখর রাখে। তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, চিত্ত বিনোদনের সব উপায় উপকরণ যেন কুরআন সুন্নাহ এবং সাহাবা কিরাম রা. এর সুমহান আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। অতএব নিম্নোক্ত কয়েকটি দিক বিবেচনায় রাখলে বিনোদনের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। মানুষের স্বভাবজাত দাবি হিসেবে দেহ ও মনের ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই জরুরী, যা সুস্থ বিনোদন ছাড়া সম্ভব নয়।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে নানা ধরণের অসুস্থ ধারায় বিনোদন এবং এসব বিনোদনের বহুবিধ উপায় উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় যুব সমাজ তাতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে তা ব্যক্তি চরিত্র ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার রুচিশীর ধারায় আঘাত হানছে। এমতাবস্থায় সুস্থ রুচির বিনোদন ব্যবস্থার প্রচলন সমাজের জন্যে অত্যন্ত জরুরী, যা নিঃসন্দেহে ব্যক্তিকে এবং সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। নারী পুরুষের জন্য শার’য়ী সীমারেখা মেনে পৃথক ভাবে তাদের স্ব স্ব স্বাভাব ও প্রকৃতি উপযোগী বিনোদন ব্যবস্থা সমাজে গড়ে তুললে তা নিজ নিজ প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হবে। শরী’আতের সুনির্দিষ্ট সীমাখোর মধ্য থেকে যে সুস্থ ও রচিশীল বিনোদন চর্চা করা হয়, তাকে ইসলামে বৈধ ঘোষণা করেছে। সুস্থ রুচি পরিপন্থি যে কোন গতানুগতিক ব্যবস্থাকে ইসলাম অনুমোদন দেয় না। এ ভিত্তিতে বিনোদনের এমন সব ব্যবস্থাকে ইসলাম বৈধতা দেয়, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধানে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিনোদনের ধরণ প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেক এর বিধানের ভিন্ন রয়েছে।
বিনোদন যদি ইসলামে নির্দেশিত নীতিমালার পরিপন্থি হয় তবে তা নিরর্থক কথা ও কর্ম হিসেবে গণ্য হবে। এ জাতীয় বিনোদনের কারণে মানব জীবনের মূল্যবান সময় বিনষ্ট হয় এবং তা জীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এরূপ চিত্ত বিনোদন এমন একটি নিরর্থক কাজ, যা একজন ইমানদার ব্যক্তির জন্য কখনো শোভা পায় না। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের অপ্রয়োজনীয় কাজ ও বিষয় থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন: আর (ঐ সকল মুমিন সফলকাম হয়েছে) যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিমুখ থেকেছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অন্য আয়াতে এসেছে: আর (দয়াময় আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হলো) যারা মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন আসার ক্রিয়া কর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলা যায়। উপর্যুক্ত কুরআনের আয়াতগুলো থেকে জানা যায়, একজন মুমিন ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় কথা কাজ বা যে কোন ধরণের বিষয় কিংবা কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে না। এ জাতীয় কার্যকলাপ তার জন্য শোভনীয়ও নয়।
বিনোদন যদি ইসলামী নীতিমালার আলোকেই সম্পন্ন করা হয় এবং এর উদ্দেশ্য ও হয় ইবাদতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, তবেই তা বৈধ। এর পক্ষে কয়েকটি দলিল নিম্নে উপস্থাপন করা হলো: ক. আবদুল্লাহ ইবনু রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. তাকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আবদুল্লা! আমাকে কি জানানো হয়নি যে, তুমি দিনের বেলায় সাওম পালন কর এবং রাতের বেলায় জেগে জেগে আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি জবাব দিলেল, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলূল্লাহ স.! রাসূল স. বললেন, তুমি এরূপ করো না। তুমি সাওম পালন করবে, আবার মাঝে মাঝে সাওম ছেড়েও দেবে, নামাজের জন্য রাতে দাঁড়াবে, আবার ঘুমাবেও। কেননা তোমার ওপর শরীরের হক রয়েছেদ, তোমার ওপর তোমার আত্মার হক রয়েছে। আর তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর ও অধিকার আছে।
উপর্যুক্ত হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ ইবাদত বন্দেগীতে ভারসাম্য রক্ষা করা পরিবারের অধিকার আদায়ের সাথে সাথে দেহ ও মনের সুস্থতা নিশ্চিত করবে। কারণ, দেহ মনের সুস্থতা ছাড়া মানুষ আল্লাহর ইবাত পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পারে না। তাই কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে মানুষের সীমিত পরিসরে চিত্ত বিনোদন উদযাপন করা শুধু বেধ নয়; বরং কোনো কোনো সময় জরুরী ও হয়ে পড়্ সেহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল স. হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস রা. কে লক্ষ্য করে বললেন: হে আবদুল্লাহ নিশ্চয়ই তুমি তো সব সাওম পালন করো। এবং সারা রাত জেগে থেকে ইবাদত করো, নিশ্চয় তুমি যদি এ রকম করেই থাকে, তাহলে তোমার চোখ দূর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, মানব শরীরের সুস্থতা, মনের প্রশান্তি ও পুরো জীবনের সঠিক ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যাশ্যকীয় এক বিধান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন