সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঢাকার কষ্ট-বিড়ম্বনা দূর হবে কবে?

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ‘কষ্ট নেবে কষ্ট/ হরেক রকম কষ্ট আছে/---/ লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট/ পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট/ আলোর মাঝে কালোর কষ্ট/ মালটি-কালার কষ্ট আছে ---’। কবি হেলাল হাফিজ ‘ফেরিঅলা’ কবিতায় রুপক অর্থেই হয়তো কষ্টের রঙের বণর্না দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকায় যারা বসবাস করেন বাস্তবেই তাদের নিত্যদিন নানান রঙের কষ্ট আর ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। যানজট কষ্ট, ময়লা আবর্জনা কষ্ট, বৃষ্টি হয়েই স্যুয়ারেজ পানির লাইন একাকারের কষ্ট, চলাচলে অযোগ্য খানাখন্দ রাস্তার কষ্ট, মশার কষ্ট, সুপেয় পানির কষ্ট, পথে বের হলে যানবাহন না পাওয়ার কষ্ট, ফুটাতে যত্রত্রত দোকান বসিয়ে পথ রোধ করার কষ্ট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-ব্যবহারিক পানির কষ্ট, কালো ধোঁয়া-বায়ু দুষণের কষ্ট, রাস্তার মাঝখানে যেখাসে সেখানে গর্তের কষ্টসহ হরেক রকমের কষ্টে দিনযাপন করতে হয়।
দিনভর গতকাল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির জন্য রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ঘর থেকে যারা বের হন কাজে কর্মে তাদের কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত ও ঘরে ফেরায় যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা বর্নণা করা কঠিন। ঘন্টার পর ঘন্টা যানবাহনে আটকে থাকার যে দৃশ্য দেখা গেল তা সত্যিই প্রীড়াদায়ক। শহরের নাগরিকদের সহায়তার জন্য যে সেক্টরগুলো রয়েছে কোনোটিই যেন ঠিকভাবে কাজ করছে না। পথে নামলেই কষ্ট-যন্ত্রণা-ভোগান্তি। নাগরিকের এই কষ্ট দূর করার জন্য রয়েছে ডেসা-ডেসকো, ওয়াসা, পিডিবি, রাজউক, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সর্বপরি সিটি কর্পোরেশন। ঢাকায় বসবাসরত নাগরিকদের কত রকমের কষ্ট আর বিড়ম্বনা সহ্য করে বসবাস করতে হচ্ছে তার কী কোনো হিসেব মেয়রদের কাছে আছে? একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের সাধারণ নগরবাসীর জন্য অতি প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধার একটাও কি ঠিকমতো মেলে? প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হয়েই সবকিছুই ভেঙ্গে পড়ে। ভিভিআইপি সড়ক হোক আর সাধারণ সড়ক হোক সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায়। রাস্তার খানাখন্দে নাগরিকদের হতে হয় নাস্তানাবুদ।
স্কুলগামী শিশুদের অবস্থা আরো করুন। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, সব মন্ত্রী-এমপি, বিদেশী কূটনীতিক ও ভিভিআইপি’র বসবাসরত এই শহরে বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, গ্যাস সরবরাহ কি পর্যাপ্ত? রাস্তাঘাট কী স্বাভাবিক ভাবে চলাচলের উপযুক্ত? বর্ষা এলেই নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তা খোড়াখুড়ি শুরু হয়। ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয় মানুষের চলাচল ব্যবস্থা। সাধারণের চলাচলের জন্য ৪/৫ হাজার পাবলিক বাস চালু আছে। কোনো বাসই নিয়ম শৃংখলা মানছে না। সরকারের বেঁধে দেয়া ভাড়ার বদলে বাসগুলোতে নেয়া হচ্ছে দ্বিগুন-তিনগুন ভাড়া। তারপরও রাস্তার দিকে তাকালেই গণপরিবহণের তীব্র সংকট দেখা যায়। সরকারি বাস যে বিআরটিসি রয়েছে সেটা অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়া। রাস্তায় শুধু সিএনজি, মিশুক, রিক্সা, ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও প্রাইভেট কার। পাবলিক বাস খুব কম চোখে পড়ে। গুলশান-বনানী-বারীধারার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় পাবলিক বাস কদাচিৎ চোখে পড়ে; সেখানে শুধু প্রাইভেট কার আর কার। নাগরিকের সুবিধার অজুহাতে বেশ কয়েকটি উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোয় কিছু মানুষের সুবিধা দিলেও শহরের যানজট কী কমাতে পেরেছে? বিপুল পরিমান অর্থে মোটা প্রকল্পগুলো নাগরিকের সুবিধার বদলে কী বেশি বিড়ম্বনায় ফেলছে না? অন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিসতো দূর অস্ত; মেট্রো রেলের মুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে গিয়ে নির্মাতারা সাধারণ মানুষকে যেভাবে কষ্ট দিচ্ছে তাতে মেট্রো রেলের প্রজেক্ট মানুষকে কত ভোগান্তিতে ফেলবে তা মনে হলে গা শিউরে উঠে। এয়ারপোর্ট রোডকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। বিমানবন্দরে বিদেশীরা নেমে প্রথমেই ভিভিআইপি এই রাস্তা ব্যবহার করেন। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল সোনারগাঁ ও রুপসী বাংলায় পৌঁছাতে বিদেশীদের কত ঘন্টা সময় লাগে? কত ঘন্টা রাস্তায় যানজটে কাটাতে হয় বিদেশী মেহমানদের? রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এক কেন্দ্রীক হওয়ায় কাজের সন্ধানে সারাদেশের মানুষ ঢাকামুখী। এই কষ্টের নগরী নিয়ে মানুষের স্বপ্নের শেষ নেই। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় আসছেন। স্বপ্ন পূরণে কেউ সফল হচ্ছেন; কেউ বা স্বপ্নের দাস হয়ে আত্মসমর্পণ করে মেনে নিয়েছেন কষ্টে যাপিত জীবন।
ইট-পাথর আর ময়লা-আবর্জনার এই শহরে যাদের গাড়ি আছে তারাই কেবল একটু ঘাম-গরম থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে নগরীতে চলাচল করতে পারছেন। তারাও শান্তিতে নেই; ফেসবুকে কষ্ট নিয়ে নানা পোস্ট দিচ্ছেন। যানজটের কারণে নিজস্ব গাড়ি থেকেও লাভ হচ্ছে না। প্রতিদিন যানজটে হাজার হাজারি লিটার তেল-পে্েট্রাল পুড়ছে; লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আঘা ঘন্টার রাস্তা মানুষ দুই তিন ঘণ্টাও পার হতে পারছেন না। পাবলিক বাস-ব্যক্তিগত গাড়ি ছেড়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সুযোগও খুব নেই। ফুটপাত হয় ছোট-খাট ব্যবসায়ীদের দখলে, প্রভাবশালীদের দখলে; নয়তো নানা জায়গায় ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। এয়ারপোর্ট রোড, মহাখালী, তেজগাঁও, ফার্মগেইট, বাংলা মোটর, শাহবাগ, মৎস্যভবন, বংশাল, যাত্রাবাড়ি, পল্টন, কাকরাইলম মালিবাগ, মগবাজার, নীলক্ষেত, সাইন্সল্যাব, আসাদগেইট, ঝিকাতলা, রামপুরা কল্যানপুর, টেকনিক্যাল, সায়েদাবাদসহ শহরের প্রায় অর্ধশত স্পটে নিত্যদিন যানজট। এ যানজট কখনো আঘা ঘন্টা কখনো বা দুই ঘন্টা। বাউল শিল্পী আবদুল করিমের গান ‘গাড়ী চলে না চলে না চলে না রে’ অবস্থা। শুধু কি যানজট! নিরাপত্তার অভাব নেই!! ক’দিন আগে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল ধ্বসে এক নারী মারা গেল। সামান্য বৃষ্টিতে দেয়াল ধ্বসের এই ঘটনা। দেয়ালের যে অংশটা এখনো ধ্বসে যায়নি, সেখানে সিটি কর্পোরেশন কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউ একটা সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড লাগানোরও দরকার মনে করেননি। দুই মেয়র দাবি করেন হেন করেছেন, তেন করেছেন। শহরের কিছু ফুটপাত আর দু একটি ট্রাক/বাস স্ট্যান্ড দখলমুক্ত করা ছাড়া এই ইট-পাথর জঙ্গলের আর কিছুই পরিষ্কার করতে পেরেছেন? নাগরিকদের সুবিধার অজুহাতে রাজধানী ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করা হলো। কিন্তু মানুষ কী সুবিধা পাচ্ছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করে চিকনগুনিয়া রোগের দায় তাদের নয়; মেয়ররা দাবি করেন মশা মারার দায় তাদের নয়। তাহলে তাদের দায়িত্ব কী? গতকালও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট ঘোষণা করা হলো। এক বছর করপোরেশনের জন্য ৩ হাজার ৩শ ৩৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলো। এই বিপুল পরিমান বাজেটের কত ভাগ নাগরিক সুবিধার জন্য ব্যয় হবে?
সামনে ঈদুল আজহা। কোরবানীর পশুর হাট নিয়ে চলছে হিসেব নিকেষ। অথচ কোরবানীর বর্জ্য পরিস্কারের জন্য কোনো মহাপরিকল্পনা নেই। প্রতিবছর কোরবানীর পশুর বর্জ্যরে দুগন্ধ পোহাতে হয় নাগরিকদের। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও ‘ঢাকার ময়লা ব্যবস্থাপনা’ বলে কোনো মহাপরিকল্পনা হয়নি। ঢাকার ময়লা কোনোমতে সংগ্রহ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, ডেমরায় ফেলে দিলেই কী কর্পোরেশনের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? এক দেড় ঘন্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর ডুবে যায়। সড়কগুলো পানিতে থই থই করে। অচল হয়ে পড়ে পুরো শহর। সু্যুয়ারেজের ময়লা পানিতে সয়লাব হয় রাস্তা। মার্কেটের দোকান, বাসাবাড়ির নীচ তলা পানিতে ডুবে যায়। কত যে কষ্ট করে এই ঢাকায় বসবসা করতে হচ্ছে। এসব ব্যাপারে শুধুই কি মেয়রদের দোষ? এই শহরে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপি সবাই বসবাস করেন। জনগণকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে চলাচলের ব্যবস্থা করায় তারা না হয় যানজটের যন্ত্রণা বুঝতে পারেন না। কিন্তু তাদের সব সময় সর্দি থাকার কথা নয় দুর্গন্ধ পাওয়ার কথা। এসি গাড়ির ভেতর থেকে গন্ধ টের পাওয়া যায়না বুঝলাম; কিন্তু তারা কী গাড়ীর ভিতরে চোখ বন্ধ করে থাকেন? একবারও বাইরে তাকান না? বাইরের মানুষের দিকে তাকালেই তো দেখা যায়, খোলা ডাস্টবিন, দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাত, ফুটপাতের উপর দিয়ে চলমান মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার আর বাসের বিকট হর্নে রিকশায় আতংকিত শিশু আর অভিভাবকদের কুঁচকে থাকা মুখাবয়ব। শহরে লেগুনা নামের একটি বাহন চলে অবৈধভাবে; এটা কি আমাদের এলিটদের প্রতিনিধি মেয়ররা জানেন না? আমাদের এই দুর্ভোগ যন্ত্রণা বিড়ম্বনা দূর হবে কবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Md Kayes Chowdhury ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:৩৭ এএম says : 0
It is very important reporting subject. Thanks to writer.
Total Reply(0)
Mijan ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১১:৩৫ এএম says : 0
যানজট নিরসনে কারো কোন মাথা বেথা নাই। কারণ যানজট কমে গেলে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আর কোন ইস্থিহার দিতে পারবে না কোন প্রার্থী । রাজনৈতিক দল গুলো কিভাবে জনগণের কষ্ট বুঝবে ?? পাচ তলায় থেকে কি আর নিচ তলায় থাকার কষ্ট কেউ বুঝতে পারে না। দিনের বার ঘণ্টা সময়ের মাঝে যদি চার ঘণ্টা সময় রাস্তার জ্যামের কারনে নষ্ট হয় , তাহলে আমাদের জনগণের কষ্ট শুধুই গরম ভাতে পানি ডেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু না। জানি না কোন সরকার প্রধান বা কোন রাজনৈতিক দল ঢাকার জ্যাম দূর করতে পারবে কি না ...............
Total Reply(0)
Khaled Hossain ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১১:৩৮ এএম says : 1
তবু ঢাকা আমার ঢাকা,এত বিড়ম্বনার পরে ও এই শহরটাই আমার খুব প্রিয়, মিস ইউ টু মাস ঢাকা।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন