তালুকদার হারুন : প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ২২ জেলায় ক্ষুদ্র খামারিদের সহায়তা প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা ১৯ কোটি টাকার সিংহভাগই প্রকল্প পরিচালকের সহায়তায় লুট করা হয়েছে। ক্ষুদ্র চাষীদের সহায়তার জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হলেও তাদের কোনো কাজে লাগেনি। জনগণ ও রাষ্ট্রের কোনো উপকারেই আসেনি এ প্রকল্প। প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য প্রকল্প পরিচালক ডা. মাহবুবুল আলম ফারুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নতুন আরেকটি প্রকল্পের পিডি হিসেবে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যেই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পের ব্যর্থতা ও পরিচালকের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি এ লক্ষ্যে কাজ করছে।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের অধীনে দেশের ২২টি জেলায় ২২টি পরীক্ষাগার স্থাপন করার কথা ছিল। জেলার ক্ষুদ্র চাষীদের ঘাসসহ অন্যান্য উদ্ভিদ পরীক্ষার জন্যই এ পরীক্ষাগারগুলো স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল। পরীক্ষাগারগুলো চালুর জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হলেও ওগুলো শেষ পর্যন্ত চালু হয়নি। শুধুমাত্র গাজিপুর জেলার পরীক্ষাগার চালু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ২২ জেলায় এ প্রকল্পের অধীনে যেসব পরীক্ষাগার তৈরি করা হয়েছিল এর সবগুলো এখন বন্ধ। কারণ ওইসব পরীক্ষাগারে যেসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছিল তা সবই নি¤œমানের। ক্রয়ের পরই ওসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। প্রকল্পের পিপি মাহবুবুল আলম ফারুক ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজসে আর্থিক সুবিধে নিয়ে অধিক মূল্যে এসব নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করে। শুধু তাই নয়,প্রকল্পের অধীনে কয়েক কোটি টাকার ওষুধ ক্রয় দেখানে হয়েছে। বাস্তবে কোনও ওষুধ ক্রয় করা হয়নি। ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে এ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্পের প্রশিক্ষণ খাতে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষণের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বাস্তবে ২০ ভাগ ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাকি টাকা ভুয়া মাস্টার রোলের মাধ্যমে উত্তোলন করে ওই টাকা পিডি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ প্রদানকালে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে ৫০ টাকা কর্তন করে রাখা হয়েছে।
লুটপাটের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্তির পরও প্রকল্প পরিচালক ডা. মাহবুুবুল আলম প্রকল্পের ১টি জিপ ও ১টি মাইক্রোবাস সার্বক্ষণিক ব্যবহার করে সরকারের হাজার হাজার টাকার জ্বালানি ও চালকের বেতন বিল পরিশোধ করেছেন। মাহবুবুল হক ফারুক বর্তমানে হ্যাচারি প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সমাপ্ত প্রকল্পের অফিস ছাড়েননি। বর্তমান প্রকল্পের ১টি জিপ ও পূর্বের প্রকল্পের ২টি গাড়ি তার বাসায় ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করলেই এর সত্যতা মিলবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঠিকাদার এ প্রতিবেদককে জানান, হ্যাচারি প্রকল্পের পিডি হিসেবে ডা. মাহবুবুল আলম ফারুক অনেকটাই বেপরোয়া। প্রকল্পের পিডি হিসেবে যোগদানের পরই ঠিকাদারদের বিল আটকিয়ে ঘুষ দাবি করছে। যেসব ঠিকাদার পিডি’র চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে পারছে, কেবল তাদেরই বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। অন্যদের বিল আটকিয়ে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, মাহবুবুল আলম ফারুক ভেটেরিনারি ক্যাডার কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি। সভাপতি হিসেবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বত্র তার প্রভাব। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাসিমের নিজস্ব লোক বলে প্রচার করে বেড়ান। আর এ পরিচয়েই তিনি প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রতিটি প্রকল্পের পিডিদের কাছ থেকে মাসে ত্রিশ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসোহারা আদায় করে থাকেন। প্রাণিসম্পদ ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাসিমের সঙ্গে ডা. ফারুকের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু বিভিন্ন প্রকল্প থেকে চাঁদাবাজি করার জন্যই বাহাউদ্দিন নাসিমের পরিচয় ব্যবহার করেন ডা. ফারুক। সম্প্রতি ইনডেপেনডেন্ট টিভি ২২ জেলায় ক্ষুদ্র খামারি প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করেছে।
এ প্রকল্পের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক ডা. মাহবুবুল আলম ফারুকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, প্রকল্পের অধীনে একমাত্র গাজিপুর পরীক্ষাগারটিই চালু করা হয়েছে। অন্যগুলোর জন্য যন্ত্রপাতি কেনা হলেও ওগুলো চালু করা যায়নি। ১৯ কোটি টাকার এই প্রকল্প ২২ জেলার ক্ষুদ্র খামারিদের কতটা কাজে এসেছে? এ প্রশ্নের তিনি কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন