শফিউল আলম : পাহাড় কেটে-খুঁড়ে ভবন ও বস্তির সারি, খাল-ছড়া ও নালার ওপর ঘরবাড়ি ও মার্কেট, পুকুর-দীঘি নির্বিচারে ভরাট, ন্যাড়া পাহাড়-টিলার কান্নাÑএই হচ্ছে হালের চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলির ব্যাপক এলাকার সাধারণ দৃশ্য। বঙ্গোপসাগরের কিনার, পাহাড়ি খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী, সারি সারি পাহাড়-টিলা আর সবুজ বনানীর সমতল কোলে চট্টগ্রামের সেই আদি পরিচিত রূপ-নিসর্গ ও বৈশিষ্ট্য দিন দিনই হারিয়ে যাচ্ছে। যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে। এতে করে ভারসাম্যহীন ও ‘কষ্টের শহর’ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম। বর্তমানে ৫০ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার ভার নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর বেসামাল দশা। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে নাগরিক যন্ত্রণা।
দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’-খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জনস্রোত বেড়েই চলেছে। সে তুলনায় বাড়ছে না আবাসন সংস্থান। আবাসন যা হচ্ছে তা বেশিরভাগই অপরিকল্পিত। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সড়ক, পার্ক-বিনোদন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পানি ও পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণপরিবহনসহ ন্যূনতম অপরিহার্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও দেশের সকল প্রান্ত থেকে আয়-রোজগারের জন্য বন্দর বা বাণিজ্যের এই নগরীতে অজস্র মানুষ ছুটে আসছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আরও সীমিত ও স্থবির হয়ে গেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজধানী ঢাকার পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিনিয়ত ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে লোকসংখ্যা। প্রতিবছর গড়ে যোগ হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার নবাগত নাগরিক। তাদের জন্য প্রয়োজন ১০ হাজার ইউনিট অতিরিক্ত ফ্লাট কিংবা বসতঘর ছাড়াও দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, অফিসসহ কর্মক্ষেত্রের মতো প্রতিষ্ঠান। অন্তত ৯০ থেকে ১২০ হেক্টর ভূমিতে আবাসন ব্যবস্থার চাহিদা বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সামুদ্রিক বন্দর, শিল্প-কারখানা, পরিবহন, শিক্ষা, প্রশাসনিক সব কাজকর্মের গুরুত্বকে ঘিরে নগরমুখী জনস্রোত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউএনডিপি, গৃহায়ন অধিদফতর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতরের বিভিন্ন জরিপ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী উপরোক্ত চালচিত্র ফুটে উঠেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যার চাপ ও আবাসন চাহিদা বাড়ছে সমানতালে। জনভার এবং নাগরিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পিত নগরায়ন জরুরী হলেও বাস্তবে তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে উঠছে বাড়িঘর ও হরেক ধরনের স্থাপনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামকে বলা হয়ে তাকে ‘প্রাচ্যের রাণী’। বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের রয়েছে স্বতন্ত্র বেশকিছু ভৌগোলিক, পরিবেশ-প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্যাবলী। পাহাড় বনাঞ্চল সাগর নদ-নদী উপত্যকা ও উপকূল মিলে পরিবেশ-প্রকৃতির ধারক বা উপাদানগুলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরিণামদর্শী মানব আগ্রাসনে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতির নিটোলরূপে গড়া ভূ-প্রকৃতি। যথেচ্ছ বাড়িঘর ছাড়াও বিস্তার লাভ করছে দোকান-পাট, গুদাম, আড়ত, কল-কারখানা, ওয়ার্কশপ, বাণিজ্য ও বিপণীকেন্দ্র। বর্তমানে মানুষের অব্যাহত চাপ মোকাবিলায় নগরজীবন হয়ে উঠেছে বিভিন্নমুখী নাগরিক ভোগান্তিতে বেসামাল।
অপরিকল্পিত নগরায়ন প্রসঙ্গে সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ গতকাল (শুক্রবার) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অবশ্যই অপরিকল্পিত উন্নয়নের নানামুখী সমস্যায় ভূগছে চট্টগ্রাম মহানগর। উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে তা বলতে গেলে খেয়ালখুশির উন্নয়ন। যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন তাদের ইচ্ছামাফিক উন্নয়ন করা হচ্ছে যেনতেন প্রকারে। অথচ মাস্টার পান অনুসরণ করা হচ্ছে না। মাস্টার পানকে বাদ দিয়ে চলতে গিয়েই উন্নয়নের নামে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। অথচ প্রচুর অর্থ ব্যয় হতে থাকলেও চট্টগ্রামবাসী সে ধরনের উন্নয়ন থেকে সুফল পাচ্ছেন না। সার্বিকভাবে ভারসাম্য হারাচ্ছে এ নগরী। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে আরবান, ট্রান্সপোর্ট ও ড্রেনেজÑ এই তিনটি নাগরিক চাহিদার সমন্বয়ে প্রণীত মাস্টার পান এবং ২০০৮ সালের ডিটেইল এরিয়া পান (ড্যাপ) অনুসরণের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, অথচ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা- সেসব পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালনা করা হচ্ছে না।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও ভূ-প্রাকৃতিক বিশেষ সব বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা হলেই পরিকল্পিত নগরায়ন হবে। কিন্তু তা উপেক্ষা করলে আত্মঘাতী বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এসব ক্ষেত্রে রেগুলেটরি এবং সহায়ক উভয় দিকেই ভূমিকা প্রয়োজন সরকারী তরফ থেকে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী কারিগরি নির্মাণ কৌশল নিশ্চিত করার পাশাপাশি পানিবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, পাহাড়ি ঢলসহ সম্ভাব্য দুর্যোগের দিকগুলো দূরদর্শী পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার প্রদান করে নগরায়ন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝিতে এদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌর শহর হিসেবে ১৮৬৩ সালের ২২ জুন ‘দি চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি’র সূচনা হয়। তখন মাত্র ৬ বর্গমাইল আয়তনের ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে শহরটি প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা করে। ১৮৬৯ সালের আদম শুমারিতে চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৯৮ জন। এখন ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে জনসংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিসপ্তাহে গড়ে প্রায় ২০০টি নতুন বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে। সিডিএ প্রতিমাসে গড়ে ২শ’ থেকে তিন শ’ নতুন বাড়ি নির্মাণের পান অনুমোদন করছে। মহানগরীর মোট ঘরবাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার। এরমধ্যে ৩৫ শতাংশ হচ্ছে পাকা দালান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন