পঞ্চায়েত হাবিব : রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রশাসনে ২৭১ জন কর্মকর্তা বর্তমানে ওএসডি। এর মধ্যে সচিব একজন, অতিরিক্ত সচিব ৩৫ জন, যুগ্ম-সচিব ৬০ জন, উপ-সচিব ৫৭ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব ৫০ জন ও সহকারী সচিব ২৬ জন। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে একই অবস্থা রয়েছে। তবে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ওএসডি বেশি নাই যা আছে সামান্য। এদিকে অকারণে অনেক ভালো কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হচ্ছে। তাদের দফতর নেই, কাজ নেই, বেতন দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। ওএসডি কর্মকর্তাদের পেছনে খরচ কোটি কোটি টাকা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিভিন্ন জেলায় এডিসি ও ইউএনও দায়িত্ব পাল করা কর্মকর্তারা এখন সচিব থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন, আর ওই সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পিএস ও এপিসসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতাবান কর্মকর্তারা ছিলেন তারা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে ২০০৯ সালের নভেম্বর থেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়। প্রায় ১১ বছরের বেশি সময় ধরে তার কোনো কাজ নেই। দফতরও নেই। আবার অনেকই বাধ্যতামূলক অবসর নিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব থাকা অনেক কর্মকর্তারা বর্তমান সরকারের সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে দায়িত্ব পালন করছে। আর বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব সালেহ আহমেদসহ অনেক কর্মকর্তা ওএসডি আছেন। এ ছাড়া সর্বশেষ ওএসডি করা হয়েছে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো: মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারীকে।
জনশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ইনকিলাবকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের যে ওএসডি করা যায় না, বিষয়টা এমন নয়। নানা কারণে তাদের ওএসডি করা যায়। উচ্চশিক্ষা ও ছুটিসহ বিভিন্ন কারণে কর্মকর্তারা ওএসডিতে থাকেন। তবে রাজনৈতিক কারণে ওএসডির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
মো: ইবাদত আলী যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের রেলপথ বিভাগের (বর্তমানে রেলপথ মন্ত্রণালয়) প্রথম সচিব ছিলেন ২০১১ সালে। তখন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন সুনামের সঙ্গেই। এর আগে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্যসসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওএসডি বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হয়। এরপর আর তার কোনো দফতরে বসার সুযোগ হয়নি। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর তার চাকরি আছে, কাজ নেই। ঠিকানা আছে, বসার জায়গা নেই। বন্ধুবান্ধবের রুমে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান তিনি। ওএসডির সময় দীর্ঘতর হওয়ায় বিব্রত পরিবারের সদস্যরাও। চাকরি জীবন শেষে তার সহকর্মীরা যখন ফুলেল ফেয়ারওয়েল নিচ্ছেন, তখন ইবাদত আলীর চোখের জলে বুক ভাসিয়ে অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায়। এরকম ওএসডি বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শুধু তিনি একা নন, তার মতো ওএসডি আছেন আরো অনেকে। তাদেরও জীবন অতিবাহিত হচ্ছে একইভাবে। রাজনৈতিক প্রতিসিংসার শিকার হওয়া এসব সরকারি কর্মকর্তার অনেকের কর্মজীবনের অবসান ঘটছে ওএসডি থেকেই। দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকার পর বিদায়বেলায় তাদের ভাগ্যে জুটছে না সামান্য ফুল কিংবা সমবেদনার কোনো বাণী। মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে অনেকেই হাঁটছেন মৃত্যুর পথে। কারণ বহু বছরের পরীক্ষিত পদ্ধতি ‘অবসর’ তখনই দেয়া হয়, যখন কর্মক্ষমতা থাকে না। অথচ কর্মঠ এসব কর্মকর্তাকে ওএসডি বানিয়ে বসিয়ে রেখে ধীরে ধীরে অক্ষম করে তোলা হচ্ছে। দেশের মানুষ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এভাবে সাধারণ মানুষকে সেবাবঞ্চিত করতে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। টাকার পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে বিপুল কর্মশক্তিরও।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রশাসনে বর্তমানে ওএসডি হিসেবে আছেন ২৭১ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে সচিব একজন, অতিরিক্ত সচিব ৩৫ জন, যুগ্ম সচিব ৬০ জন, উপ-সচিব ৫৭ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব ৫০ জন ও সহকারী সচিব ২৬ জন। এ ছাড়া অ্যাটাচমেন্ট বা সংযুক্তিতে আছেন দেড় শতাধিক কর্মকর্তা। অনেক কর্মকর্তা ওএসডির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অ্যাটাচমেন্ট পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে তাদের অন্ততপক্ষে বসার জায়গাটুকু নিশ্চিত হয়। ফলে কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সংযুক্ত করে রাখা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জনপ্রশাসনে ওএসডি হলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কিছু নির্ধারিত কাজ করতে পারেন। তবে তাকে যে মন্ত্রণালয়ে অ্যাটাচমেন্ট দেয়া হয়, সেই মন্ত্রণালয় থেকে বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। বেতন-ভাতা নিতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। এ ছাড়া বেতন-ভাতার সুবিধা নিয়ে ১০০ জন কর্মকর্তা শিক্ষা ছুটি ও প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে থাকায় ওএসডি হয়ে আছেন। ৩৫ জন কর্মকর্তা বেতন-ভাতার সুবিধা ছাড়াই শিক্ষা ছুটি বা প্রশিক্ষণের জন্য ওএসডি রয়েছেন। এ ছাড়া দুর্নীতি, শৃঙ্খলাজনিত ও অসদাচরণের জন্য কিছু কর্মকর্তা ওএসডি আছেন। সবমিলে প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা ওএসডি।
ওএসডি হয়ে থাকা কর্মকর্তারা সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে হাজিরা খাতায় সই করে সেখানেই অলস সময় কাটান। বসার আলাদা স্থান না থাকায় লাইব্রেরিতে দৈনিক পত্রিকা ও বইপত্র পড়ে দিন কাটে তাদের। প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার কোনো নিয়ম না থাকলেও ওএসডি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর করতে হয় প্রতিদিন। সরকারের এই শীর্ষ কর্মকর্তারা এভাবে দিন কাটাতে হয় বলে অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। বিশেষ করে যাদের চাকরির বয়স বেশি দিন নেই, তারা চরম অবসাদগ্রস্ত। আর যারা চাকরি জীবনের শুরুতেই ওএসডি হয়ে আছেন, সেসব তরুণ কর্মকর্তা অনেক হতাশ। অতিরিক্ত সচিব (ওএসডি) মো: শাহ আলম ইনকিলাবকে বলেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে কিছু বলার নাই। চাকরি যতদিন আছে ততদিন এভাবে চলে যাবে। দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা যুগ্মসচিব (ওএসডি) মো: মশিউর রহমান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে আবেদন করে চিঠিতে লিখেছেন, আমি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকতা। আমার ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা সচিব হয়েছে। আমি পদবঞ্চিত হয়েছি। ২০১৬ সালের পদোন্নতি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে আমার স্কোর ৮৪.৯৫ হওয়ার এসএসবির সভায় আমাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আমার চেয়ে কম স্কোর পেয়ে কিভাবে সচিব পদোন্নতি পায় আমি জানতে চাই। যুগ্মসচিব (ওএসডি) মো: মশিউর রহমান বলেন, আমার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ, তারপরও আমাকে বিএনপি-জামায়তের কর্মকর্তা বলা হয়। আর যারা বিএনপির সময় জেলায় এডিসি ও ইউএনও দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা তারা এখন সচিব থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-সচিব (ওএসডি) বলেন, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু ওএসডি হয়ে বসে থাকায় নিজেকে অনেকে খারাপ লাগছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, একজন অতিরিক্ত সচিবের বেতন স্কেল ৬৬ হাজার থেকে ৭৬ হাজার টাকা। একজন যুগ্ম-সচিবের মাসিক বেতন স্কেল ৫৬ থেকে ৭৪ হাজার টাকা। একজন উপ-সচিবের মাসিক বেতন স্কেল ৪৩ হাজার থেকে ৬৯ হাজার টাকা। সিনিয়র সহকারী সচিবের মাসিক বেতন ৩৫ হাজার থেকে ৬৭ হাজার টাকা। সহকারী সচিবের বেতন ২২ হাজার থেকে ৬৩ হাজার টাকা।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অধিকার বজায় রাখা সরকারের দায়িত্ব। কর্মকর্তারাও সরকারের কাজ করতে বাধ্য। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হলে দলীয়করণমুক্ত প্রশাসনের আশা করা যায় না। সাবেক সচিব বলেন, এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন করা কঠিন হয়ে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন