ঢাকাই সিনেমার রাজপুত্তুর নায়করাজ রাজ্জাকের ইন্তেকালের পর তাঁকে নিয়ে প্রচুর স্মৃতি রোমন্থন হচ্ছে। রাজ্জাকের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, ৫০ বছর ওঠাবসা করেছেন, এমন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সহকর্মীরা টিভির টকশো এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় তাঁর কর্মকান্ড তুলে ধরছেন। শুধু আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীই নয়; মানুষ হিসেবে রাজ্জাক যে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন সেটা তুলে ধরছেন। আরো কয়েক দিন হয়তো এভাবে রাজ্জাককে নিয়ে মিডিয়ায় তাঁর অনুসারীরা সরব থাকবেন। কিন্তু মুসলিম ঘরে জন্ম নেয়া রাজ্জাক যে উপমহাদেশের সংস্কৃতিসেবীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে গেলেন; পথ দেখালেন তা কেউ তুলে ধরছেন না! তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে ইসলামবিদ্বেষী না হয়েও একজন ইসলামিস্ট হয়েই সাংস্কৃতি অঙ্গনে ঝড় তোলা যায়; প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, সেটা রাজ্জাক দেখিয়ে গেছেন। তাঁর এই পথ অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয়।
সাংস্কৃতি নিয়ে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন, ‘রাজনৈতিক আগ্রাসনের চেয়ে সংস্কৃতির আগ্রাসন অধিক মারাত্মক’। দার্শনীক অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন ‘সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশ্রুত জীবনচেতনা। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর শোভন পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি’। এটা মেনেই নায়করাজ রাজ্জাক বিজাতীয় সাংস্কৃতি আগ্রাসনের ঢেউয়ের শ্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। মুসলিম নাম চাপা দিয়ে হিন্দুয়ানী নাম ধারণ করে সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙার চেষ্টা করেননি। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে তিনি নিজেকের একজন খাঁটি মুসলমান দেশপ্রেমিকের মতোই সাংস্কৃতির অঙ্গনে বিচরণ করেছেন।
১৯৪২ সালে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার টালিগঞ্জে জন্ম নেয়া রাজ্জাক ১৯৬৪ সালে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সময় শরণার্থী হিসেবে ঢাকায় আসেন। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে নাট্যাঙ্গনে নিজেকে জড়ান। অভিনেতা হওয়ার মানসে ১৯৬১ সালে কলকাতা থেকে হিন্দি ছবির রাজধানীখ্যাত মুম্বাই পাড়ি দেন; মুসলমান হওয়ায় সেখানে সফল হতে না পেরে ফিরে আসেন কলকাতার টালিগঞ্জে। মুসলিম নাম গোপন করে দিলীপ কুমারের মতো হিন্দু নাম ধারণ করে তিনিও সেখানে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারতেন। কিন্তু সে পথে যাননি। মুসলমান হওয়ায় জন্মস্থান কলকাতার টালিগঞ্জেও সুবিধা করতে পারেননি। অথচ মাথায় অভিনয়ের পোকা। মন সায় না দেয়ায় নিজের ধর্মীয় পরিচয় বিসর্জন দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেননি। মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে মুসলমান পরিচয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। এক সময় সফলতা তার পায়ের নিচে লুটিয়ে পড়েছে।
মুম্বাই সিনেমার দিকে তাকালে কী দেখি? হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া বলিউডে কেউ সুবিধা করতে পারে না। সে জন্য বলিউডের অসামান্য অভিনেতার দিলীপ কুমার ধর্মীয় পরিচয় এবং মুসলিম নাম মোহাম্মদ ইউসুফ খান বাদ দিয়ে ‘দিলীপ কুমার’ নাম ধারণ করে সিনেমায় প্রতিষ্ঠা পান। শাহরুখ খান হিন্দি সিনেমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মুসলিম নাম আবদুল রশিদ খান বাদ দিয়ে ‘শাহরুখ খান’ ধারণ করেন। তিনি মুম্বাই সিনেমায় প্রথমে মো: আবদুর রশিদ খান নামে অভিনয় শুরু করেন। মুসলিম হওয়ায় দীর্ঘ পাঁচ বছর হিন্দি দর্শকরা তাকে গ্রহণ করেনি। অতপর নাম পরিবর্তন করে শাহরুখ খান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বর্তমানে হয়েছেন বলিউডের বাদশা। নায়ক সালমান খানের নামও ছিল মো: আবদুল রশিদ খান সেলিম। মুসলমান নামের নায়ককে গ্রহণ না করায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি আধাহিন্দু-আধামুসলিম ‘সালমান খান’ নাম ধারণ করেন। নায়ক আমির খানের নামও ছিল মোহম্মদ আমির হুসেন খান। তিনি সাফল্য পেতে মুসলিম ধর্মীয় পরিচয় চাপা দিয়ে ফিল্মি জগতে হন ‘আমির খান’। মুম্বাইয়ের সিনেমা জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ছিল মুসলিম তরুণ অভিনেতা রাজ্জাকের। কিন্তু ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে সিনেমা জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত হতে দিলীপ কুমার, শাহরুখ খান, সালমান খানেরা নিজেকে মুসলিম পরিচিতি গোপনের কৌশল নেন; অথচ রাজ্জাক সে পথে না হেঁটে নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচিত করতেই মুম্বাই ছেড়ে ঢাকায় আসেন। কাজেই রাজ্জাকের সঙ্গে ওই সব হিন্দি সিনেমার ওই নায়কদের কি তুলনা চলে?
দেশের সাংস্কৃতি অঙ্গনে রাজ্জাক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর অভিনীত সিনেমা ষাট-সত্তুর-আশি-নব্বই দশক টানা চার দশক ব্যবসাসফল। যে ছবিতে অভিনয় করেছেন সে ছবি সফল ব্যবসা করেছে। তারপরও বলতে হয় আমাদের দেশের সংস্কৃতির বর্তমানে বেহাল দশা। এর দায় কার? মনন ও চিন্তা-চেতনায় দেশে রাজ্জাকের মতো আর দশজন অভিনেতা অভিনেত্রী থাকলে কি সাংস্কৃতির এই করুণ অবস্থা হতো? প্রগতিশীলতার নামে দেশে সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতি চর্চা যারা করছেন এমন ব্যক্তিদের বিশাল একটা অংশ বর্তমানে রাজনৈতিক দলদাস। দেশজ সাংস্কৃতি চর্চার বদলে তারা বিজাতীয় সাংস্কৃতি ফেরি করতে অভ্যস্থ। সাংস্কৃতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো- ভাবগত ঐক্য এবং তার প্রকাশ ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের রূপ। গুণীজনদের মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির আয়নাস্বরূপ। শিল্পী হিসেবে রাজ্জাক হৃদয় দিয়ে সেটা দেখেছিলেন এবং মেনেছিলেন। আজ যারা তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করছেন, তাদের কতজন তা মানতেন? সংস্কৃতি একটি আঞ্চলের মানবগোষ্ঠীর রীতি-নীতির পরিশীলিত, কর্ষিত এবং ঐতিহ্য তুলে ধরে। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিতে বহুমাত্রিক উপাদান রয়েছে। যুগের পর যুগ গবেষণা করে গবেষকরা সে চিত্র তুলে ধরেছেন। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশের ঐতিহ্যগতভাবে সংস্কৃতি চর্চা বিদ্যমান। আমাদের সমাজে নিজস্ব ভাব ও ভাষার প্রকাশের নিজস্ব ঢং আছে। মুসলিম সমাজের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশ্বজনীনতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি, পবিত্রতা, দায়িত্ববোধ ও ভারসাম্য। ইসলামের ইতিহাসেও সাংস্কৃতির ব্যাপ্তি বিশাল। দেশীয় অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী, ভাড়াটিয়া রাজনীতিবিদ ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যখন নিজেদের ব্যক্তি লাভালাভের স্বার্থে বিজাতীয় সংস্কৃতির দূতের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ; তখন নায়ক হিসেবে ওজনদার হওয়ার পরও রাজ্জাক নিজেকে সেই সুবিধাবাদীদের শ্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। একদিকে দেশের সাংস্কৃতি ধ্বংস, অন্যদিকে বিজাতীয় সাংস্কৃতির চর্চার নামে এখনো সাংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। স্মরণ করুণ বিদেশি সিনেমা বন্ধের দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন হচ্ছে। যৌথ প্রযোজনার ছবি বন্ধের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। ভালো কথা। কিন্তু দেশের দর্শক কী চায় তা বোঝার চেষ্টা করছেন কতজন শিল্পী? গত কয়েক মাসে দেশের কয়েকটি টেলিভিশন মুসলিম শাসকদের দেশ শাসন, আরব্য উপন্যাস, সারাবিশ্বে মুসলিম জাগরণ, ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুসলিম শাককদের ইসলামি চেতনা-ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়ে নির্মিত বিদেশি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে টিভিতে প্রচার করে। ওইসব সিরিয়াল দেখার জন্য দেশের দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সিরিয়াল দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোও ওইসব সিরিয়ালে বিজ্ঞাপন বাড়িয়ে দেয়। অথচ দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল সাংস্কৃতিসেবীরা দর্শকদের সেই চাহিদামতো ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে নাটক-সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী হচ্ছেন না। কারণ তথাকথিত প্রগতিশীল। তারা বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের দেশের দর্শকদের মস্তিস্কে প্রবেশ করানোর এজেন্সি নিয়ে বসে আছেন। কিন্তু রাজ্জাক ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র এবং অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র কোনো কিছুই তাঁর চলার পথে বাধা হতে পারেনি। তিনি দেশজ সাংস্কৃতি চর্চা করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারত দু’দেশের রাজ্জাকের ছবি ছিল জনপ্রিয়। বর্তমানে দেশের কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অতিমাত্রায় ভারতপ্রীতি দেখাচ্ছেন; অথচ ভারতে জন্ম দিয়েও রাজ্জাকের চরিত্রে সেটা দেখা যায়নি। কবি কাজী নজরুলের মতোই তিনিও বাংলাদেশকেই হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। এটাই হয়তো রাজ্জাককে স্মরণীয় করে রাখবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন