সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মাদারীপুরের ৯ যুবক লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার মুক্তিপণ দিয়েও মিলছে না মুক্তি

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের এক নারীসহ ৫ দালাল গ্রেফতার

আবুল হাসান সোহেল মাদারীপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 মাদারীপুরের একই গ্রামের ৭জনসহ জেলার ৯ যুবক লিবিয়ার টর্চার সেলে জিম্মি রেখে চরম নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণ করে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশী দালালদের কাছে। এখানে দালালরা ঐ সব যুবকের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনকে ভিডিও দেখিয়ে দফায় দফায় বিপুল অংকের টাকার মুক্তিপণ আদায় করছে। 

কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিলেও মুক্তি পাচ্ছে না নির্যাতিত যুবকরা। উপরোন্তু আরো টাকা আদায়ের জন্য হত্যার হুমকি দিয়ে তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশ এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের এক নারীসহ ৫ দালালকে গ্রেফতার করেছে। ভূক্তভূগীদের পরিবার, র‌্যাব-৮ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ খালিয়ার একই গ্রামের ৭ যুবককে অবৈধ পথে লিবিয়ায় নেয় আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের এ দেশের দালালরা। এ জন্য তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা করে ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেয় তারা। এই ৭ যুবক হলো-নয়ন বাড়ৈর ছেলে নিতাই বাড়ৈ, প্রেম চাঁদ মন্ডলের ছেলে গোবিন্দ মন্ডল, বিভূতি সরকারের ছেলে বিজন সরকার, পার্থ মন্ডলের ছেলে লিটু মন্ডল, মধু মন্ডলের ছেলে মনোরঞ্জন মন্ডল, প্রশান্ত বাড়ৈর ছেলে প্রকাশ বাড়ৈ ও তারা বাওয়ালীর ছেলে জাহিদুল বাওয়ালী ।
প্রথমে এ সব যুবককে লিবিয়া নিয়েই জিম্মি করে ফেলে। তারপরে শুরু হয় তাদের উপর বর্বর নির্যাতন। মারধর, হত্যার ভয় দেখিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালাতে থাকে তাদের উপর। এই নির্যাতনের ইমুতে ধারণ করা ভিডিও তাদের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে মোটা অংকের মুক্তিপণের দাবি করে। এরপর এ সব পরিবারের কাছ থেকে ২/৩ দফায় ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দেশীয় দালালের মাধ্যমে। তারপরও মুক্তি মেলেনি লিবিয়ায় আটকদের। র‌্যাব-৮ জানায়, শুধু এরাই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাওয়া শতশত যুবক এই ফাঁদে পা দিয়ে লিবিয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এ চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ, লিবিয়া ও ইতালীতে সমভাবে সক্রিয় রয়েছে। এদের একজন শিবচরের সিরাজ মাতুব্বর (৫২)। মাদারীপুর র‌্যাব-৮ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ২১ আগষ্ট সোমবার মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের ধয়াটী গ্রাম থেকে সিরাজ মাতুব্বরকে গ্রেফতার করে। এই সিাজ মাতুব্বরের ছেলে মো. শহিদুল মাতুব্বর আন্তর্জাতিক চক্রের লিবিয়া অংশের অন্যতম প্রধান। লিবিয়ায় শহীদুলের টর্চার সেলে চালানো হচ্ছে এই নিষ্ঠুর বর্বরতা।
গত ২২ আগষ্ট এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মাদারীপুর র‌্যাব-৮এর কোম্পানী কমান্ডার মেজর মো. রাকিবুজ্জামান বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত সিরাজ মাতুব্বর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঐ চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য বলে স্বীকার করেছে। তার কাছ থেকে মানবপাচারের মাধ্যমে অর্জিত টাকা ব্যাংকে জমার রশিদ, ষ্টাম্পে লিখিত চুক্তিনামাসহ বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণপত্র উদ্ধার করা হয়। লিবিয়া অংশের অন্যতম প্রধান মো. শহিদুল মাতুব্বর তার ছেলে। চক্রটি শহিদুলের নেতৃত্বে গঠিত লিবিয়ার বন্দী শিবিরে পাচারকৃত বাংলাদেশী যুবকদেরকে অর্ধাহারে-অনাহরে রেখে নানাবিধি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং সিরাজ মাতুব্বরসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত সদস্যরা পাচারের শিকার যুবকদের আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে। এছাড়া তাদের কাছে গত ৬ মার্চ ২৮ জন যুবককে পাচারের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে ৮ জন লিবিয়ায় শহিদুল মাতুব্বরের কাছে জিম্মি অবস্থায় বন্দি রয়েছে। এই ৩৬ জনকে পাচারের আগে চক্রটি ৩৫ লাখ টাকা আদায় করেছে। লিবিয়ার প্রেরণের পর এসব জিম্মিদের পরিবারের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই আরো প্রায় ২০ লাখ টাকা আদায় করেছে চক্রটি।’
এদিকে লিবিয়া থেকে ইতালী নেওয়ার কথা বলে শিবচরের দত্তপাড়ার ২ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি করে প্রায় ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে মানব পাচারকারী একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রের ১ নারী সদস্যসহ ৩ সদস্যকে ল²ীপুর ও কুমিল­া থেকে গ্রেফতার করেছে শিবচর থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো-আলমগীর হোসেন রিপন, তার শ্যালিকা নয়ন আক্তার ও বিকাশ এজেন্ট সামচু।
পুলিশ ও নির্যাতিতদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের চর বাচামারা আদেল হাজীর কান্দি গ্রামের তারা মিয়া খলিফার ছেলে শাহিন ও তার চাচাতো ভাই রবিউল খলিফা ঢাকায় থাকা অবস্থায় ল²ীপুরের আলমগীর হোসেন রিপন ও তার শ্যালিকা নয়ন আক্তারের সাথে পরিচয় হয়। তারা শাহিন ও রবিউলকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইটালী পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। শাহিন ও রবিউল পরিবারের কাছে জানালে তারা সম্মতি দিলে চলতি বছরের ১৪ মে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রথমে তাদেরকে মিশর পাঠায় আলমগীর। গত ২১ জুন মিশর থেকে ইটালী নেওয়া জন্য তাদেকে লিবিয়া পাচার করে। শাহিন ও রবিউলকে লিবিয়া নিয়ে ওই দালাল চক্রের আরো ৮/১০ জন সদস্য তাদেরকে আটক করে শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে দেখিয়ে তাদের কাছে মুক্তিপণ দাবী করে চক্রটি। মুক্তিপণ না দিলে তাদেরকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। ছেলেদের জীবন বাঁচাতে চক্রটির দাবীকৃত মুক্তিপণের টাকাও দেয় ঐ দুই পরিবার। এ পর্যন্ত বিকাশ ও ব্যাংকের মাধ্যমে কয়েক দফায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা নিয়েও শাহিন ও রবিউলকে মুক্তি না দেওয়ায় গত ৬ সেপ্টেমবর ৪ জনকে আসামী করে শিবচর থানায় অভিযোগ করে শাহিনের বাবা তারা মিয়া খলিফা। অভিযোগের প্রেক্ষিতে শনিবার গভীর রাতে ল²ীপুর ও কুমিল­া জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে শিবচর থানা পুলিশ। এসময় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য আলমগীর হোসেন রিপন (৪০), তার শ্যালিকা নয়ন আক্তার (২৮) ও সামচুকে (৪২) গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত বিকাশ এজেন্ট সামচুর বিকাশ একাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। আলমগীর ল²ীপুর সদর উপজেলার চরমনসা গ্রামের মৃত নাজির আহমেদ খানের ছেলে, নয়ন আক্তার একই গ্রামের শাহিন আলমের স্ত্রী ও সামচু কুমিল­ার মুরাদনগরের পাঁচপুকুরিয়া গ্রামের ইসমাইল ক্বারীর ছেলে। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৮ এর মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাকিবউজ্জামান বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার সন্ধ্যায় শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার পশ্চিম লোনসিং গ্রামে অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য সুমন ছৈয়ালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে ঐ গ্রামের আব্দুল হামিদ ছৈয়ালের ছেলে। গ্রেফতারকৃত সুমন ছৈয়াল প্রাথমিকভাবে লিবিয়ায় ১৫ থেকে ২০ জনকে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করেছে। তার কাছ থেকে ১৫ লাখ ২৮ হাজার নগদ টাকা, ৩ হাজার ইউরো, ৫৯টি সিম ও ২৯টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে
বাংলাদেশ, লিবিয়া ও ইতালীতে সমভাবে সক্রিয় এবং এদের শিকার মূলত মধ্যবিত্ত ও নিমèমধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সের বেকার যুবকরা। চক্রটি বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে যুবকগণকে লিবিয়ায় পাচার করে থাকে। পরে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যরা লিবিয়ার বন্দিশালায় তাদেরকে আটকে রেখে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং বন্দীদের নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দাবী করে।’ র‌্যাব-৮ এর মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মো. রাকিবউজ্জামান বলেন, ‘লিবিয়ার বন্দিশালার নেতৃত্ব দেন সুমনের বড় ভাই সুজন ছৈয়াল (৪৫)। তাকে লিবিয়ার দুতাবাসের মাধ্যমে ধরার প্রক্রিয়া চলছে।’ এছাড়া একটি মোবাইল নাম্বারে একসাথে অনেক টাকা বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব না হওয়ায় একাধিক সীমকার্ড সুমন ব্যবহার করত বলেও জানান তিনি। শিবচর থানার অফিসার ইনচার্জ জাকির হোসেন বলেন, ‘এরা সংঘবদ্ধ একটি মানব পাচারকারী দল। শিবচরের ২ যুবককে লিবিয়া জিম্মি করে কয়েক দফায় মুক্তিপণ নিয়েও তাদের ছাড়েনি। আমরা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষে সত্যতা পেয়ে ল²ীপুর ও কুমিল­া থেকে তাদের গ্রেফতার করেছি।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন