রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা

প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : নির্মলা মিশ্রের গাওয়া জনপ্রিয় গান ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে। এমন একটা মানুষ খুঁজে পেলাম না যার মন আছে’। গানের সুর ধরে আমাদের কোন গীতিকার যদি লেখেন এমন একটা দপ্তর পেলাম না যেখানে স্বচ্ছতা বা জবাবদিহি আছে। এমনটি বোধ হয় খুব একটা বেসুরো হবে না। সম্প্রতি এক জম্পেস আড্ডায় নানা বিষয় নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আইনজীবী নেতা চিকিৎসক, সরকারী কর্মকর্তা। ব্যাংকার, সাংবাদিক, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরো বেশ ক’জন। আলোচনায় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি, হয়রানী, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবস্থা স্থান পায়। হত্যা, খুন, গুম, নির্যাতন বিশেষ করে শিশুহত্যা নির্যাতনের বিষয়টা নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করা হয়। কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম। চলে উপস্থিত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাটির দিকে ছোঁড়া হয় নানা প্রশ্নবান। পুলিশ জনগণের বন্ধু না শত্রু এমন প্রশ্ন ওঠে। উদাহরণ তুলে কড়া সমালোচনা হয়। একজন প্রশ্ন করেন এমন একটা থানা দেখান তার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি বা হয়রানীর অভিযোগ না আছে। অনেক থানার নামের আগে মডেল লেখা আছে। আসলে কিসের মডেল। রয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেখানে কতটুকু সার্ভিস পাচ্ছে। টাকা ছাড়া একটা জিডি হয় না। জিডি লিখে নিয়ে গেলেও বলা হয় এটা হয়নি। থানার মুন্সির কাছে যান সে লিখে দেবে। মুন্সির ইচ্ছে মতো হয় জিডির ভাষা। যত খরচ তত কড়া ধারা। চুরি, ছিনতাই, ভয়ভীতি দেখানো হলেও লাভ নেই বলে সাধারণ মানুষ থানার পথ মাড়ায় কম। থানার অভিযোগের খাতায় থাকে মামলার সংখ্যা কম। হয়ে যায় মডেল থানা। হাজারো কথার পর মুখ খোলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। বলেন খালি খালি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এক তরফা দোষারোপ করেন কেন? পুলিশের অতীত ইতিহাস তো এমন নয়। মোদ্দাকথা আমাদের অসুস্থ রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সবখানে। আমরা সর্বত্র বাজে অবস্থা। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে তার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে থানার ওসির ভূমিকায় দলের ছায়া সভাপতি সেক্রেটারীর। মন্ত্রী-এমপির আশীর্বাদপুষ্টদের কথামত না চলায় কত ওসি আর এএসআইদের নাজেহাল হতে হয়েছে তার খবর কি আপনারা রাখেন? দলের জন্য অর্থের যোগান দিতেও হয়। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত অনেক চাহিদা মেটাতে হয়। পুলিশকে দলের লাঠিয়াল বাহিনী করলে যা হবার তাই হচ্ছে। সবাই সুযোগ নিচ্ছে। এক তরফা দোষারোপ করে লাভ নেই। দুর্নীতির বিষ বাষ্পতো এখন সর্বত্র। খালি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে আঙ্গুল কেন। এদের সবাই ভাল যেমন বলা যাবে না। তেমনি সবাই খারাপ নয়। পরিস্থিতি তাদের বিভ্রান্ত হতে বাধ্য করছে। প্রসঙ্গ চলে যায় উপস্থিত ভূমি অফিসের এক কর্তার দিকে। সবচেয়ে দুর্নীতি আর হয়রানীর আখড়া হিসাবে উঠে আসে ভূমি অফিসের নাম। নানা উদাহরণ দিয়ে চলে দপ্তরটির উদ্যেশে হোয়াইট ওয়াস। এমন একটা ভূমি অফিস খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে হয়রানী, ঘুষ আর দুর্নীতি নেই। আপনার কাগজপত্র ঠিক থাক। এমনকি আপনার পক্ষে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আছে। তারপরও সঠিক পথে গেলে আপনার নামজারী হবে না। মাধ্যম না ধরলে মাসের পর মাস ঘুরতে হবে। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল গেলে উঠবে নানা আইনী প্রশ্ন। আটকে যাবে ফাইল। এখানে ফেলকড়ি মাখো তেল নীতি অবলম্বন করলে ফাইল তৈলাক্ত হয়ে সচল হয়ে যাবে। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের হোমড়া-চোমড়া হলে ভিন্ন কথা। ভূমি অফিসে সাধারণ মানুষের কি যে হয়রানী তা প্রত্যক্ষ না করলে বোঝা যাবে না। পবার এক এসিল্যান্ড ক’দিন তার অফিসের কার্যক্রম স্বচ্ছ করার জন্য দরবার খুলে বসেন। যেখানে বসে আগতদের সমস্যা শোনেন ও কিছু সমাধান করে পত্রিকার শিরোনাম হন। গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু তিনি জানেন কি জালাল নামের রিক্সা চালকটি বছরের পর বছর ধরে ঘুরছেন তার অফিসে। তার সাধ্য হয়নি এসিল্যান্ডের কাছে যাবার। এমন জালাল অনেক আছে। উদ্যোগ ভাল তবে স্ট্যান্ডবাজি ভাল নয়। দেখাদেখি আরেক ভূমি অফিস তার সাইনবোর্ড লিখে ছিল দুর্নীতিমুক্ত ভূমি অফিস। সাইনবোর্ডে যাই লেখা হোক, সেখানে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানানো যায়। প্রশ্ন উঠলো এতদিন কি ভূমি অফিস দুর্নীতিতে ভরা ছিল। অনেকে ব্যাঙ্গ করে মন্তব্য করেছিল আসলে এটি দুর্নীতিমুক্ত নয় হবে দুর্নীতিযুক্ত। পরে অবশ্য সাইবোর্ড মুছে ফেলে শুধু ভূমি অফিস লেখা হয়। ভূমি অফিসের কর্তাটি অসহায়ের মত বলেন সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ছোবল সর্বত্র। আমরাই বা বাদ কেন? টাকা লেনদেনের ভাগতো অনেক স্থানে যায়। প্রশ্নের তীর ঘুরে যায় চিকিৎসকের দিকে। মানব সেবারব্রত নিয়ে পেশায় এসেছেন। বাস্তবে কি হচ্ছে। বলা হচ্ছে মানব সেবা নয় মানব বাণিজ্যে ব্যস্ত তারা। কি সরকারী হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক সর্বত্র হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ভেজাল খেয়ে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসার জন্য ভীড় করছে এসব স্থানে। গরীব মানুষের ভরসা সরকারী হাসপাতাল। সেখানে কতটুকু চিকিৎসা সেবা মিলছে। যারা একবার হাসপাতালে যাবেন। তারা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাবেন কত ধানে কত চাল। ওষুধপত্রের জন্য সরকারী কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। জনগণের টাকা দিয়ে নামি-দামী চিকিৎসক আর সেবক-সেবিকা রাখা হয়েছে। বাস্তবে কি সেবা মিলছে। বড় বড় হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা তো ইন্টার্নী নির্ভর। রাউন্ডে এলে বড় ডাক্তারের দেখা মেলে। ওষুধ লিখে দিলেও হাসপাতাল থেকে দু’একটার বেশী মেলে না। বেশিরভাগ ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। দামি-দামী যন্ত্রপাতি থাকলেও প্রায়শই অচল হয়ে পড়ে রহস্যজনক কারণে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় চিকিৎসকের পছন্দের ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে। পথ্যও ঠিক মত মেলে না। দরপত্রে বড় বড় রুই দেবার কথা থাকলেও গ্রাসকাপ, সিলভারকাপ জাতীয় মাছ বেশী আসে। যাদের সামর্থ নেই তারা বাধ্য হয়ে ওসব খায়। হাসপাতালের ওষুধ রোগী না পেলেও সরকারী ওষুধ সীমান্তের ওপারে পাচার করে আনা হয় ফেন্সিডিল। বেসরকারী হাসপাতালে মরা মানুষকে আইসিইউতে রাখার নামে আদায় করা হয় অর্থ। কতটা অমানুষ হলে এমনটি হতে পারে। আর হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় ছোট ছোট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে চিকিৎসা বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকেন বড়রা। চিকিৎসাকে ঘিরে কতরকম বাণিজ্য, ভাড়া ছাড়াও যেখানে বসা হবে সেখানে থেকে কমিশন, যেখানে রিপোর্ট লেখার জন্য পাঠানো হবে সেখানে থেকে কমিশন, আর ওষধ কোম্পানী তো রয়েছে। একজন এক সেন্টারে দু’ঘন্টা বসেন তো আরেক স্থানে কিছুক্ষণ। এভাবে চলে প্রেসক্রিপসান বিতরণ আর আহরণ। কোন নিয়ম-নীতির বালাই ও নিয়ন্ত্রণ নেই। যেভাবে যে পারছে সে কামায় করছে। উপস্থিত ডাক্তার সাহেবের গম্ভীর মন্তব্য সবাইকে এক পাল্লায় মাপবেন না। আড্ডায় বারের নির্বাচিত নেতাও ছিলেন। বিচারপাড়া নিয়ে চলে নানা মন্তব্য। লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মানুষের বিচার পাবার আশ্রয়স্থল হলো আদালত। সেখানেও পোহাতে হয় নানা রকম ঝামেলা। মক্কেল-দালাল আর আইনজীবীসহ নানা মানুষে ভরা। মক্কেল ধরা দালালরা বেপরোয়া। বেশকিছু আইনজীবীর সাথে এদের রয়েছে সুসম্পর্ক। এরাই বিভিন্ন স্থান হতে মামলা এনে দেয়। শুরুতেই কোট ফি হতে নানা অজুহাতে চলে টাকা আদায়। মামলা রুজু। এরপর শুরু হয় ঘাটে ঘাটে অর্থ খরচ। নইলে যে মামলা গতিহারায়। প্রত্যেক তারিখে দিতে হয় টাকা। পরবর্তী তারিখ নিতেও নাকি টাকা লাগে। জামিন হয়েছে, বেলবন্ড নিতে হলেও টাকা। আর পুলিশের জিআরও অফিস তো যেন টাকার জন্য বসে আছে। অবশ্য এজন্য বেশকিছু সুবিধা দেয়া হয়। আসামীর সাথে স্বজনদের দেখা করার ও খাবার দেবার সুযোগ ইত্যাদি। যাদের সামর্থ নেই তারা শুধু কোটহাজত থেকে আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সময়টুকু দেখতে পাবে বিনে পয়সায়। অনেক আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বাদী-বিবাদী দু’পক্ষের সাথে নিবীড় যোগাযোগ রাখায়। এতে মামলার ফলাফল পর্যন্ত পাল্টে যায়। বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে জামিন নেবার ঘটনা নজীর রয়েছে। সিভিল কেসের সমনজারী একটা বড় ফ্যাক্টর। এখানেও কড়ি না দিয়ে কাজ হয় না। জারী করতে ফেরত নথি অন্তর্ভুক্ত করতে সবক্ষেত্রে দিতে হয় অর্থ। আদালতপাড়ার কর্মকা-ে আইনজীবীরা বিব্রত। দু’জন তরুণ আইনজীবী তাদের শুরুর প্রথম কটাদিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন কিভাবে মানুষের পকেটে থেকে টাকা নিতে হয় আদালতপাড়ায় গেলে বোঝা যায়। তারা বলেন, হয়তো এ পেশায় টিকতে পারব না। আইনজীবী সমিতির নেতার মন্তব্য সর্বক্ষেত্রে ভালমন্দ থাকে। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি যতটুকু ভাল রাখা যায়। অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হলে অনেক অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব। প্রদীপের নীচে অন্ধকার রেখে আলো আশা করা যায় কতটুকু। বাদ গেলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহেবও। উঠল শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষারমান, শিক্ষকদের কথা। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ আছে। সকল শিক্ষক কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কি হয়। এমন সব নানা বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। ভদ্রলোক অকপটে স্বীকার করেন শিক্ষার মান নেমে যাবার কথা। কিছু শিক্ষকের স্ব-স্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার কথা। বিশেষ করে সর্বত্র রাজনীতির অপছায়ার অনুপ্রবেশ। এখন শিক্ষা নিয়োগে যোগতার অন্যতম মাপকাঠি হলো দলের প্রতি আনুগত্য। যে যত আনুগত্য দেখাবে সে তত ভাল বলে বিবেচিত হবে। ভিসি-প্রোভিসি রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় বলে তাদের উপর ক্ষমতাসীনদের চাপও বেশী থাকে। অন্যায় অনেক আবদার করে। সব আবদার পূরণ করা সম্ভব হয় না বলে তাদের গালমন্দ এমনকি নাজেহাল হবার ঘটনাও কম নয়। অনেকে শিক্ষকের বিবেক এসব সায় দেয় না। কিন্তু দলীয় আনুগত্যের কাছে একেবারে অসহায়। যারা দলভুক্ত নন তাদের অবস্থা হলো না পারেন বলতে না পারেন সইতে। চোখ মুখ বন্ধ করে নিজ দায়িত্ব পালন করে যান। তাদের ভাষায় সমটা বড্ড খারাপ। বাদ গেলেন না উপস্থিত সাংবাদিকও। বলা হলো, আপনাদের বেশীর ভাগ তো দলকানা পোষ মানা হয়ে গেছেন। নিজেদের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে যে যেমন পারছেন চলছেন। সেজন্য তো সাংবাদিক হত্যার বিচারও পান না। আর গণমাধ্যম তো এখন প্রায় দল মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বিরুদ্ধে গেলেই খবর আছে। এর মধ্যেও যারা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সালাম জানাতেই হয়। বিকেলের আড্ডা অনেক রাত অবদি গড়ায়। কথায় কথায় কখন যে সময় চলে গেছে টের পাওয়া যায়নি। আড্ডার সব প্রসঙ্গেই উঠে আসেÑ নৈরাজ্য, হানাহানি, খুন, জখম, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, নিয়োগ, বাণিজ্য, নারী, শিশুহত্যা, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের কথা। বাদ যায়নি নির্বাচন কমিশন আর দুদকও। সব কথার শেষ মন্তব্য ছিল সর্বাঙ্গে ব্যাথা। ওষুধ দেব কোথা। সব ছড়িয়ে পড়ছে ক্যান্সারের মত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন