শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

আশুরার চেতনা ও আজকের প্রেক্ষিত

মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মুহররম। এ মাসেরই দশম দিবস ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে অভিহিত। প্রাচীনকালের নানা জনগোষ্ঠীর কাছেও আশুরা পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। ইহুদিদের কাছে আশুরা ‘জাতীয় মুক্তি দিবস’ হিসেবে পরিচিত। আশুরার মর্যাদা ইসলামেও স্বীকৃত। আশুরার দিনে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়। মুসলমানরা রোজা পালনের মাধ্যমে আশুরার মাহাত্ম্য স্মরণ করে থাকে।

আসমান-জমিন, আরশ-কুরসি ও আদিপিতা আদম আ.-এর সৃষ্টি, ধরাপৃষ্ঠে প্রথম বারিবর্ষণ, হজরত নূহ আ.-এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ, ফেরাউনের নির্যাতন থেকে হজরত মুসা আ. কর্তৃক ইহুদিদের উদ্ধার, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে হজরত আইয়ুব আ.-এর সুস্থতালাভ, মৎস্য উদর থেকে হজরত ইউনুস আ.-এর নির্গমন, হজরত সুলায়মান আ.-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রদান, নমরুদের অগ্নিকুÐ থেকে হজরত ইবরাহীম আ.-এর নিষ্কৃতি, হজরত ইয়াকুব আ.-এর চক্ষুজ্যোতি পুনঃপ্রাপ্তি, কূপ থেকে হজরত ইউসুফ আ.-কে উদ্ধার, হজরত ইদরিস আ. ও হজরত ঈসা আ.-কে আসমানে উত্তোলন, কারবালায় হজরত হোসাইন রা.-এর শাহাদাতসহ বিপুল ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী ‘আশুরা’। (ফাজায়েলে মুহাররম, পৃ. ৩৫-৩৬)
সর্বশেষ কেয়ামতও এ দিবসেই সংঘটিত হবে হবে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে।
মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.-এর আদরের দুলাল এবং ইসলামের ইতিহাসের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রা. ও নবীদুলালী ফাতিমাতুজ্জাহরা রা.-এর পুত্র ইমাম হোসাইন রা.। চতুর্থ হিজরির ৩ শাবান শনিবার মদিনায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অসত্যের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সত্য পথযাত্রীদের প্রাণের সান্ত¡না। স্বৈরশাসক ও জালিম শাহীর পতন আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল আপসহীন। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, দুঃশাসনের জগদ্দল পাথর সরিয়ে জাতির কল্যাণে মানবতাবাদীদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। ৬১ হিজরির ১০ মহররম সপরিবারে তাকে নির্দয়ভাবে শহীদ করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলো সিনান ইবনে আনাস মতান্তরে আমর ইবনে জিলসাওসান।
ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করার কাহিনি বড়ই মর্মান্তিক। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, পিতা আলী রা.-এর শাহাদাতলাভের পর ইমাম হোসাইন রা. স্বীয় বড়ভাই হযরত হাসান রা.-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৬ মাস পর হযরত হাসান রা. আমিরে মুয়াবিয়ার সঙ্গে পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার হাতে খেলাফতের দায়িত্বভার তুলে দেন। এতে ইমাম হোসাইন রা. অসন্তুষ্ট হয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু পরে বড়ভাইয়ের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত সম্মতি প্রকাশ করেন।
৬০ হিজরিতে আমিরে মুয়াবিয়া রা. ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং তার হাতে সংঘবদ্ধভাবে উম্মতের বাইয়াত প্রদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেই সময়ে যেহেতু ইয়াজিদের চেয়েও খেলাফতের উপযুক্ত সাহাবীগণ জীবিত ছিলেন, তাই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এ প্রস্তাবে আপত্তি তোলেন। এমনকি অধিকাংশ সাহাবী তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
এদিকে ইয়াজিদ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সর্বপ্রথম যারা তার বাইয়াত গ্রহণ করেনি, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সঙ্গত কারণেই শুরু হয়ে যায় ইমাম হোসাইন রা. ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের ওপর ইয়াজিদি নির্যাতন। এতে সত্যের পতাকাবাহী আপসহীন সংগ্রামী ইমাম হোসাইন রা. মদিনা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক সেই সময়ে ইরাকের কুফাবাসী বিভিন্ন চিঠিপত্র এবং প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে ইমাম হোসাইন রা.কে রাষ্ট্রাধিনায়ক মেনে নেয়া এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব পাঠায়। তারা একই সঙ্গে ইয়াজিদি দুঃশাসনের যাঁতাকল থেকে জাতির মুক্তি-সংগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার অঙ্গীকার জানায়। ইতোমধ্যেই ১৮ হাজার কুফাবাসী ইমাম হোসাইন রা.-এর নামে বাইয়াত গ্রহণ করে। তাই ইমাম হোসাইন রা. নিশ্চিন্তে কুফায় আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এদিকে হাজার হাজার কুফাবাসীর পক্ষ হতে ইমাম হোসাইনের নামে বাইয়াত গ্রহণের কথা ইয়াজিদের কানে পৌঁছে যায়। ইয়াজিদ কালবিলম্ব না করে তৎকালীন গভর্নর নোমান বিন বশিরকে বরখাস্ত করে উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে তদস্থলে গভর্নর মনোনীত করে। নবনিযুক্ত উবায়দুল্লাহ কুফায় এসেই কঠোর নীতি অবলম্বন করে। একইভাবে ইয়াজিদের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য ইমাম হোসাইন রা.-এর বিশ্বস্ত সহচর মুসলিম বিন আকিলকে গ্রেফতার করে হত্যা করে।
ইমাম হোসাইন রা. পথিমধ্যে এ নির্মম কাহিনী শুনতে পান এবং পরিস্থিতি আঁচ করতে সক্ষম হন। তারপরও দৃঢ়প্রত্যয়ী হোসাইন রা. দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে রাস্তা থেকে ফিরে আসাকে সঙ্গত মনে করলেন না। এক পর্যায়ে মাঝপথে ফোরাত নদীর তীরবর্তী ‘কারবালা’ নামক স্থানে উবায়দুল্লাহর সৈন্যবাহিনী তাকে অবরোধ করে দাঁড়ায়।
ইমাম হোসাইন রা. নির্ভয়ে দীপ্তভাবে ইয়াজিদের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে আবেগবিহŸল কণ্ঠে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন : “উপস্থিত বন্ধুরা! তোমরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করছ। অথচ আমার একটি মাত্র অপরাধ যে, আমি ইয়াজিদের মতো একজন পথভ্রষ্ট ও অধার্মিক ব্যক্তিকে মুসলমানদের আমির স্বীকার করতে পারিনি। আর সে অপরাধেই তোমরা আমার রক্ত প্রবাহিত করতে দাঁড়িয়েছ?”
ইমাম হোসাইন রা.-এর এ আবেগময় বক্তব্য শোনার পর ইয়াজিদের একমাত্র সেনাপতি ‘হোর’ ইয়াজিদি দল ত্যাগ করে হোসাইন রা.-এর দলে এসে যোগ দেয়। ফলে শুরু হয় যুদ্ধ। বীর বিক্রমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইমাম বাহিনীর সবাই। ঈমানি বলে বলীয়ান নির্ভীক সৈনিকরা একে একে সবাই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। শহীদদের তাজা খুনে লাল হয়ে যায় ফোরাতের তীর। এই হলো কারবালা ও ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনায় দৃষ্টি নিবন্ধ করলে ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাতের বেশ কিছু কারণ উদঘাটিত হয়। মূলত ইমাম হোসাইন রা.-কে শহীদ হতে হয় জালিম শাসক ইয়াজিদ সরকারের বিচ্যুতির প্রতিকার চাইতে গিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন শাসনব্যবস্থাকে তার সঠিক অবস্থানে নিয়ে আসতে। তিনি চেয়েছিলেন মজলুম মানবতার মুক্তি। তাঁর সংগ্রাম কোনো কাফের শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না; বরং তা ছিল নামধারী মুসলিম শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে। ইসলামের লেবেল গায়ে জড়িয়ে যারা অনৈসলামিক কর্মকাÐকে জায়েজ বানাতে চায়, ইমাম হোসাইন রা.-এর সংগ্রাম ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
ইমাম হোসাইন রা.-এর সংগ্রাম ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধ। সেটি ছিল মানবতার মুক্তি, দুঃশাসন থেকে মুক্তি। এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অপশক্তির সাথে যে কখনো আপস হতে পারে না, জোট হতে পারে না, ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাতের স্মৃতি বিজড়িত আশুরা ও মহররম তা-ই শিক্ষা দেয়। কখনো জাতির স্বাধীনতা হরণ করা হলে কিংবা স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে যে গর্জে ওঠতে হয় আশুরা ও মহররম তা-ই শেখায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী নেটওয়ার্ক যে অত্যন্ত সুবিস্তৃত। এ জন্য সত্য পথযাত্রীদের টুঁটি চেপে হত্যার পরম্পরায়ই ইমাম হোসাইনকে শহীদ হতে হয়।
নিষ্ঠুর ইতিহাসের সংঘটক কেউই যে মহান আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় বিধান হতে রেহাই পায় না, কারবালায় ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাতের পর তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। হযরত ইমাম হোসাইন রা.-এর নির্মম মৃত্যু সংবাদ শুনে মক্কা, মদিনা ও কুফায় বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। বিক্ষুব্ধ জনতা ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে দুরাত্মা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। এ বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী নেতা মুখতার। তিনি কুফার ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ইমাম হোসাইন রা.-এর হত্যাকাÐে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। এ সংঘর্ষে ইয়াজিদ সেনাপতি সীমারসহ ২৮৪ জন ঘাতক প্রাণ হারায়। এক পর্যায়ে মুখতার সদলবলে কুফার গভর্নর আবদুল্লাহ বিন জিয়াদের সম্মুখীন হয়। টাইগ্রীস নদের শাখা জাবের তীরে উভয়ের যুদ্ধ চলাকালে কুখ্যাত জিয়াদ এক সাধারণ সৈনিকের বর্শাঘাতে বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
জাতি যখন ইয়াজিদি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছিল না, সত্য উপলব্ধি করার পরও যখন তারা অনিয়ম, নির্যাতন নীরবে হজম করে চলছিল, তখন ঈমানের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সাহসের বলিষ্ঠ উচ্চারণে ইমাম হোসাইন রা. ফোরাতের তীরে ছুটে আসেন। ইয়াজিদি স্বৈরশাসন মেনে নিলেই তাকে এমন নির্মমভাবে কারবালার মরুপ্রান্তরে প্রাণ দিতে হতো না। সামান্য আপসকামী হলেই শহীদি রক্তের ফোঁটায় ফোরাত নদীর পানি রক্তবর্ণ ধারণ করত না। কিন্তু ইমাম হোসাইন রা. আপসহীনভাবে জাহেলিয়াতের কালো পর্দা উন্মোচন করে সত্যকে প্রোজ্জ্বল করেন। তাইতো জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের ও জিল্লতের পরিবর্তে নাজাতের মহিমায় ভাস্বর ঐতিহাসিক দিবসের নাম আশুরা।
পৃথিবীর ইতিহাসে সত্য প্রতিষ্ঠাকারীদের আদর্শে শানিত মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাতের স্মৃতি বিজড়িত কারবালার ঘটনা বাতিলের বিরুদ্ধে হকের চিরন্তন সংগ্রামের এক নবতর সংযোজন। প্রতি বছর সেই কারবালা দিবস এসে আমাদেরকে ঈমান ও দেশমাতৃকার প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে যুগের ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে শেখায়। প্রয়োজনে বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের শিক্ষা দেয়। আর এ জন্যে প্রয়োজন ধৈর্যের-ত্যাগের।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন