হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান প্রবেশ পথ, বিমানবন্দরের সামনে ট্রাফিক পয়েন্ট ও আশপাশ এলাকা নিরাপত্তাহীন। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে গোলচত্বর, ফুটওভারব্রিজ এবং ওই এলাকার প্রধান সড়কের উভয় পাশে প্রতিদিন বসছে শত শত ভাসমান দোকানপাট ও হকার। এ ছাড়া ভিক্ষুক এবং ভবঘুরে মানুষের ভিড় তো আছেই। আকাশ পথে যাতায়াতের প্রধান এ বিমানবন্দরটি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন হুমকির মুখে।
হকার ও ভিক্ষুকদের কারণে বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও বিমান যাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রতিনিয়ত। বিমানবন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এলাকায় হকার ভিখারি ও অনাকাক্সিক্ষত মানুষের ভিড়ের কারণে দেশ সম্পর্কে মারাত্মক নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হচ্ছে বিদেশিদের কাছে। শুধু তাই নয়, এ কারণে নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই বিমানবন্দর এলাকায় এ ধরনের ভাসমান দোকানপাট, হকার ও ভিক্ষুক চোখে পড়ে না। এ বিষয়টি যে দেশের ইমেজ বা ভাবমর্যাদার সাথে জড়িত; তা নিয়ে সংশ্লিষ্ঠদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কয়েক মাস আগে বিমানবন্দরের নিকটবর্তী এলাকায় র্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা এবং চুরি নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে এক সন্ত্রাসী কর্মরত একজন আনসার সদস্যকে হত্যার পরও নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নেয়নি এপিবিএন ও সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগ। বরং বলা চলে, বিমানবন্দরের সামন ও প্রবেশ পথ এখন হকার ও ভিক্ষুকদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাশেদা সুলতানা বলেন, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বিমানবন্দরের ভেতরে। বাইরের দায়িত্ব এপিবিএন পালন করে। ভেতরে নিরাপত্তা জোরদার আছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রবেশপথে যানবাহন থামিয়ে চলছে দফায় দফায় তল্লাশি। এপিবিএন সদস্যরা গাড়ি থামিয়ে তল্লাশির নামে যাত্রীদের অবান্তর প্রশ্ন করেন। তবে এতসব কথিত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও হকার, চানাচুর বিক্রেতা, আমড়া বিক্রেতা ও ভিক্ষুকদের উৎপাত থেমে নেই। প্রতিদিনই অবাধে ভিড় করছে হকার ও ভিক্ষুকরা। বিমানবন্দরের প্রবেশ পথের নিরাপত্তা চেকপোস্টের সামনেই যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে ভিক্ষুকদের কবলে। একদিকে এপিবিএন চেকপোস্টে যাত্রীদের তল্লাশি করছেন, অন্যদিকে তাদের সামনেই বিদেশ ফেরত যাত্রীদের গাড়িতে হানা দিচ্ছে ভিক্ষুকরা। বিশেষ করে বিদেশি দেখলেই ভিক্ষুকরা হামলে পড়ছে তাদের গাড়িতে। বিমানবন্দরের সামনে যানজটের কারণে যখন গাড়ি থেমে থাকে, তখন ভিক্ষুকরা নাছোড়বান্দাদের মতো আচরণ করে বিদেশিদের সাথে। তাদের হাতে টাকা না দেয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়ছে না গাড়ির। এ কারণে ভুক্তভোগী যাত্রীরা নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। লন্ডনপ্রবাসী সিলেটের আলতাব মিযার সাথে গতকাল কথা হয় বিমানবন্দরের প্রবেশ পথে। তিনি বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর একটি এলাকায় কী করে ভিক্ষুকেরা ভিড় করছে। এতে শুধু নিরাপত্তাই হুমকির মুখে নয়, দেশি-বিদেশি যাত্রীরাও ভিক্ষুকদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন। বিদেশিদের মধ্যেও নিরাপত্তা নিয়ে খারাপ বার্তা যাচ্ছে বিমানবন্দরের আসার পরপরই।
গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিন-চার জন ভিক্ষুক যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় যাত্রীদের গাড়ি যখন আটকা পড়ে; তখনই তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এপিবিএনের তিন-চারজন সদস্য। এ সময় গাড়িতে বসা এক ব্যক্তি একজন ভিক্ষুকের হাতে ১০ টাকা দেয়ার পর সে ওই টাকা ফেরৎ দিয়ে ডলার দাবি করে। একপর্যায়ে গাড়ির জানালায় রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। গতকাল দুপুর ১২টার সময় একই স্থানে কয়েকজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। তাদের ছবি তুলতে গেলে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। এসময় ছবি তুলতে নিষেধ করেন এপিবিএনের সদস্যরা। দেখা গেছে, ১৫-২০ মিনিট পর আবারো সেখানে তিন জন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূলত দুই ধরনের। কোর সিকিউরিটি বা ফিজিক্যাল সিকিউরিটি এবং এভিয়েশন সিকিউরিটি বা নন-কোর সিকিউরিটি। ফিজিক্যাল সিকিউরিটির আওতায় বিমানবন্দরের বহিরাঙ্গন, রানওয়ে, অপারেশন টাওয়ার, রাডার স্টেশন, মার্কার, ভিওআর, লোকালাইজারহ সব ধরনের স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা ও অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো। অন্যদিকে এভিয়েশন সিকিউরিটির আওতায় বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশের সময় যাত্রীর দেহ তল্লাশি ও লাগেজ চেক, কার্গো চেক, স্ক্রিনিং, ফ্লাইট সেফটি এবং আনুষঙ্গিক কাজ।
এদিকে সিভিল এভিয়েশন এবং বিমানবন্দর সংলগ্ন অন্যান্য অফিসে যাতায়াত করতে প্রতিদিনই এপিবিএনের তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সিভিল এভিয়েশনের পাস ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কাস্টমস ও কার্গো ভিলেজে যাতায়াত করতেও সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্ট ব্যসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তবে ভিক্ষুক ও ফেরিওয়ালা ঠিকই ওই এলাকায় প্রবেশ করছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনের একজন এএসপি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনি পরে ফোন করেন, বিস্তারিত বলা যাবে। এর পর বিমানবন্দরের ভেতরে এপিবিএনের অফিসে গিয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হলেও ভেতরে যেতে দেয়া হয়নি। র্যাব সদরদফতর থেকে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে চাইলে নিরাপত্তার অজুহাতে ওই পথে গাড়ি প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে এপিবিএনের এএসপি জিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ রাস্তায় প্রবেশ করা যাবে না। তিনি বলেন, আপনি সাংবাদিক হোন আর যেই হোন, উত্তরা জসিম উদ্দিন রোড দিয়ে ঘুরে প্রধান সড়ক হয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে হবে। অথচ ওই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন শত শত গাড়ি যাচ্ছে। যদিও বলা হয়েছে এসব গাড়িতে সিভিল এভিয়েশনের পাস আছে, আসলে অধিকাংশ গাড়িতে সিভিল এভিয়েশনের স্টিকার লাগানো নেই।
সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফিজিক্যাল সিকিউরিটির দায়িত্বে রয়েছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এএপিবিএন)। অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির অধীনে এভিয়েশন সিকিউরিটির দায়িত্বে আছে এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ড, অ্যাভসেক এবং আনসার বাহিনী। দেশে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিমানবাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স অ্যাভসেক। এ ছাড়া, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন শাহজালালে।
সূত্র জানায়, এ বছর ১৮ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন রাশেদা সুলতানা। এর আগে তিনি সিভিল এভিয়েশন অথরিটির সহকারী পরিচালকের (নিরাপত্তার) দায়িত্বে ছিলেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এএপিবিএন) জানিয়েছে, প্রায় ১১ শ’ এএপিবিএন সদস্য শাহজালালে দায়িত্ব পালন করছেন। ৫০ জন অস্ত্রধারীসহ ৭০৩ জন সদস্য বিমানবন্দরে কাজ করছেন। তবে সিভিল এভিয়েশনের অধীনে এভিয়েশন সিকিউরিটি গার্ড ও অ্যাভসেক-এ কত জন কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন এ তথ্য জানায়নি কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বিমানবন্দরের সামনে ফুটপাত দখল করে শত শত ভাসমান দোকান বসানো হয়েছে। বিমাবন্দর রেলস্টেশন থেকে গোলচত্বর পর্যন্ত এবং পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে বসানো হয়েছে শত শত ভাসমান দোকানপাট। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সহযোগিতায় স্থানীয় চাঁদাবাজ ও প্রভাবশালীরা দোকানপাট বসিয়েছে। এতে বিমানবন্দরের শুধু নিরাপত্তাই হুমকির মধ্যে নয়, পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন