\ সাত \
কাজেই বিনোদনের নামে ইসলাম এমন কোন তৎপরতা বা আয়োজনকে সমর্থন দেয় না, যাতে নারী পুরুষের পারস্পরিক পর্দার বিধান লংঘিত হয়। বিনোদন এমন হবে না, যা ব্যক্তিকে শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব অথবা সামাজিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখে।
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, বিনোদন মানুষের মুখ্য বিষয় নয়; বরং আনন্দময় জীবনের একটি সহায়ক উপায় মাত্র। এ জন্যে বিনোদনের যে সমস্ত উপায় উপকরণ মানুষকে স্রষ্টার বন্দেগী থেকে গাফিল করে এবং সামাজিক নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের অমনোযোগী করে তুলে, সর্বোপরি যা মানুষকে হারামের দিকে ধাবিত করে এ রকম বিনোদন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশিষ্ট গবেষক আবু যুহরা রহ. বলেন: শরীআতপ্রণেতা যখন বান্দার ওপর কোন বিষয় পালন করা বাধ্যতামূলক করে দেন, তখন ঐ বিষয় পালনের যা মাধ্যম তাও বান্দাহর কাছ থেকে প্রত্যাশিত। পক্ষান্তরে যখন শরীআতপ্রণেতা কোন বিষয় থেকে মানুষকে নিষেধ করেন, তখন ঐ নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি যে সব বিষয় ব্যক্তিকে ধাবিত করে তাও হারাম হিসেবে গণ্য। বিনোদন যেন বিনোদনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির জন্যে ক্ষতিকর না হয়- বিনোদন চর্চা করতে গিয়ে যদি তা ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনের কারণ হয়, তাহলে এটি ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন: নিজের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এবং অপরকে ক্ষতিগ্রস্থ করা ইসলামী নীতি নয়।
বিনোদন যদি মানুষের জীবনে লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়, তাহলে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা ইসলামী শরীআতের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি হলো: ক্ষতি দূর করা কল্যাণ লাভের ওপর প্রাধান্য পাবে। সুতরাং এ মূলনীতির ভিত্তিতে বলা যায়, বর্তমানে প্রচলিত মুষ্টি যুদ্ধ ও কুস্তিখেলা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ এসব খেলার বর্তমান পদ্ধতিতে খোলোয়াড়দের অঙ্গহানি, এমনকি মৃত্যুর সম্ভবনা ও থাকে।
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এক পূণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলামের এ পূর্ণাঙ্গতা রাসূল স. এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। ইসলামের প্রতিটি বিধানের পেছনে রয়েছে কিছু হিসত ও লক্ষ্য। সে হিসেবে রাসূল স. এর প্রচলিত বিনোদনের ও সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য বিদ্যমান ছিল। যেমন-
রাসূলুল্লাহ স.- এর যুগে চিন্তা পেরেশানী দূরীভূত করে মনের মধ্যে প্রফুল্লতা সঞ্চারের উদ্দেশ্যে বিনোদন ব্যবস্থার আয়োজন করা হতো। সাথে সাথে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ইসলামও সমাজ সেবায় উপযোগী করে গড়ে তোলাও বিনোদনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। ইবনু উমার থেকে রা. থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূল স. বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অশ্বগুলোর দৌড়প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন। (প্রতিযোগিতার স্থান ছিল) হাইফা থেকে ছানিয়্যাতুল বিদা পর্যন্ত। অন্য দিকে, যে ঘোড়াগুলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় সেগুলোর দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন ছানিয়্যাতুল বিদা থেকে বনু যুরাইকের মসজিদ পর্যন্ত। ইবনু উমার রা. ও সে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাসূল স.ও সাহাবা কিরামের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও স¤প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করা ঃ রাসূল স. এর যুগে বিনোদনের একটি বড় লক্ষ্য ছি, যেন তাঁর ও সাহাবা কিরামের মাঝে পারস্পরিক ভালবাসার বন্ধন র্দঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। সালামা ইবলু আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন: একবার রাসূলূল্লাহ স. আসলাম গোত্রের একদল সাহাবীর পাশ দিয়ে গেলেন, যারা তীরন্দাজি করছিল, রাসূল স. তাঁদেরকে বললেন, হে ইসমাইলের বংশধর, তোমরা তীরন্দাজি করো, কেননা তোমাদের পিতা ছিলেন তীরন্দাজ। তোমরা তীর নিক্ষেপ করো, আমি অমুক গোত্রের সাথে আছি। রসূল স. এর কথা বলার পর তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় রত একদল লোক তীরন্দাজি থেকে বিরত থাকলো। অতঃপর রাসূল স. তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো, তোমরা তীরন্দাজি করছো না কেন? তাঁরা বললেন, আমরা কিভাবে তীরন্দাজি করবো, আপনি যে তাদের সাথে? তখন রাসূল স. বললেন. তোমরা তীর নিক্ষেপ করো, আমি তোমাদের প্রত্যেকের সাথে আছি। উপর্যূক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায়, রাসূল স. স্বীয় সাহাবা কিরামের সাথে এভাবে মিশতেন, যাতে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত হয় এবং রাসূল স. এর সাথে তাঁদের প্রীতি ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।
রাসূলূল্লাহ স. এর কিছু বিনোদনকর্ম এমন ছিল, যাতে পরিবার পরিজনকে আনন্দ দান ও তাঁদেরকে প্রফুল্ল করা হতো। উ¤মূল মুমিনীয় আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা এ বিষয়ের উজ্জ্বল প্রমান। তিনি বলেন: আমরা একবার রাসূল স. এর সাথে সফরে ছিলাম। আমরা এক জায়গায় যাত্রা বিরতি করলাম, রাসূল স. আমাকে বললেন, আস! আমি তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিন। আয়িশা রা. বলেন, সেই প্রতিযোগিায় রাসূল স. কে পিছনে ফেলে আমি বিজয়ী হই। এ ঘটনার পর অন্য এক সফরে আমি রাসূল স. এর সাথে কোন এক জায়গায় যাত্রা বিরতি করলাম। রাসূল স. বলেন, আমাকে বললেন, আস! তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিই। আয়িশা রা. বরেন, এবারের প্রতিযোগিতায় রাসূল স. আমার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে বিজয়ী হলেন। অতঃপর রাসূল স. আমার স্বন্ধে (হাত) রেখে বললেন,এ বিজয় ঐ (আগেরবার) তোমার বিজয়ী হওয়ার বদরায়।
উপর্যুক্ত বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, রাসূল স. পরিবার পরিজনকে আনন্দ দানের জন্যে মাঝে মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতাসহ নানা আনন্দদায়ক বিষয়ের অবতরণা করতেন, যা ছিল শরীয়তের সীমারেখার মধ্যেই। উক্ববা ইবনে আমির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল স. ইরশাদ করেন: প্রত্যেক খেলাই বাজে কাজ (অর্থহীন), তবে কেউ তার তীর নিয়ে তীরন্দাজি শিখে, তার ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং নিজের স্ত্রীর সাথে খেলাধুলা ও ফুর্তি করে (তাহলে দোষ নেই) কেননা এ কাজগুলো হক্ব বা সুসংগত কাজ। মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা।
বিনোদনমূলক কর্মকান্ড চর্চার মাধ্যমে মানুষের শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখা যায়। মানুষের দৈহিক সক্ষমতা বহাল রাখতে ইসলাম মানুষকে উৎসাহিত করেছে। কারণ শারীরিক সবলতা ও সুস্থতা ব্যক্তির সামগ্রিক দায় দায়িত্ব পালনে খুবই জরুরী। এ প্রসঙ্গে রাসূল স. ইরশাদ করেন: দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন অনেক উত্তম ও আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, সবার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।
রাসূল স. এর যুগে প্রচলিত বিনোদনের আরেকটি লক্ষ্য ছিল, মানুষকে এ কথা বোঝানো যে, ইসলামের বিধি বিধান উদারনৈতিক ও প্রশস্ত। এতে কোন সংকীর্ণতা বা সীমালংঘন নেই। ইসলামে রয়েছে মানুষের প্রতিভা বিকাশের সুন্দর সুযোগ। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো- রাসূল স. তার স্ত্রী আয়িশা রা. এর সাথে খেলাধুলা, তাঁর কন্যা ও মহিলা সাহাবীগণের খেলার সুযোগ করে দেয়া ইত্যাদি। উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা. বলেন: আমি নবী স. এর উপস্থিতিতে ছোট বালিকাদের সাথে পুতুল সাজিয়ে খেলতাম, আমার কিছু সঙ্গিনী ছিলো, যারা আমার সাথে খেলতো যখন রাসূল স. ঘরে প্রবেশ করতেন তখন তারা দৌড়ে পালাতো। রাসূল স. তাদেরকে ডেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তখন তারা আমার সাথে খেলতো। অপর বর্ণনায় এসেছে, হাবশীরা যখন মসজিদে নববীতে তীরন্দাজি করছিল, তখন রাসূল স. তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: যাতে করে ইয়াহুদীরা জানতে পারে যে, আমাদের দীনে প্রশস্ততা আছে আর আমি প্রেরিত হয়েছি তাওহীদি চিন্তা চেতনাপুষ্ট সরল সহজ উদার দীন সহকারে।
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা ও দাবি পূরণে সুস্থ, সুন্দর ও যৌক্তিক পন্থা উপস্থাপন করেছে। জীবনের কোন দিক ও বিভাগ ইসলামে উপেক্ষিত নয়। এ হিসেবে আমরা দেখি, ইসলাম মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্যে সুস্থ ধারার এমন অনেক পদ্ধতিও বিনোদমূলক কর্মকান্ড উপস্থাপন করেছে, যাতে কোন সীমা লংঘনও নেই এবং যা দ্বারা মানুষের কোন মৌলিক কর্ম সম্পাদনে ব্যাঘাত ও ঘটে না। নিম্নে বিনোদনের কিছু ধরণ তোলে ধরা হলো, যেগুলোর প্রমান ও অস্তিত্ব ইসলামের সোনালী যুগে পাওয়া যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন