সরকারী উদ্যোগ ও সহায়তা ছাড়া শুধুমাত্র বেসরকারী উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা রেডিমেড গার্মেন্ট(আরএমজি) খাতের সঙ্কট ঘনীভ’ত হচ্ছে। এই শিল্পখাতের স্বার্থরক্ষায় উদ্যোক্তা প্রতিনিধিদের কোন মাথাব্যথা নেই। বিশেষত: বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেন পোশাক কারখানার উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার চাইতে ক্ষতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় বেশী ব্যস্ত থাকছেন। গার্মেন্ট রফতানীখাত একের পর এক বাজার হারাচ্ছে, লোকসানের মুখে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হারানোা দায় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ নেতারাও এড়াতে পারেননা। বিগত দশকে অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত এতটা নেতিবাচক ধারায় যায়নি। সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ ও ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব সবচে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের গার্মেন্ট শিল্প। চীন, জাপান কোরিয়ার মত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থানান্তরিত করার যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তা’ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অ্যাপারেল রফতানী ইতিমধ্যে ৫০বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারতো। অথচ চলতি অর্থবছরে তৈরী পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি ০.২০ ভাগ যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানী খাতে যখন নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের পোশাক রফতানীখাতে ডাবল ডিজিটের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অ্যাপারেল বাজার ক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে। দুই বছর আগেও মার্কিন বাজারে বাংলাদেশ ছিল দ্বিতীয় অ্যাপারেল রফতানীকারক দেশ। এখন সেখান থেকে ছিটকে চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত নিয়ে দেশি-বিদেশি মহলের ষড়যন্ত্রের যোগসাজশ কোন নতুন ঘটনা নয়। রানা প্লাজা ধসের পর সেই সুযোগ সন্ধানী চক্র নতুন ফাঁদ হিসেবে গার্মেন্টস কারখানাগুলোর উপর নানা ধরণের শর্ত চাপিয়ে দেয়। গত কয়েক বছর ধরে অ্যাকর্ড-এলায়েন্সের তৎপরতা বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অ্যাকর্ড এলায়েন্স নানা ধরনের শর্ত আরোপ করলেও তারা পোশাকের ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি বা বাজার সম্প্রসারণে কোন ইতিবাচক ভ’মিকা নেয়নি। এ সময়ে শুধুমাত্র ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে সহস্রাধিক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের তৈরী পোশাক রফতানীখাত নিয়ে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্বেগ প্রকাশিত হলেও সে সময়কার এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’র নেতাদের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলেই বেশী তৎপর দেখা গেছে। অথচ দেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য এসব বণিক সংগঠন কার্যকর ভ’মিকা রাখতে পারত। অতীতে তারা যেমন সঠিক সময়ে সঠিক অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো তাদের সে অবস্থান বদলায়নি। গার্মেন্ট শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় তাদের এই ব্যর্থতা প্রকারান্তরে ভারতসহ প্রতিদ্ব›িদ্ব দেশগুলোকে বাজার দখলের সুযোগ করে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ভারতের তৈরী পোশাক রফতানী খাতের প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ, যা চলতি অর্থবছরে ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌছবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
দেশের গার্মেন্ট রফতানীতে চ্যালেঞ্জগুলো ঠিকমত তুলে ধরতেও ব্যর্থ হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এ সম্পর্কে সঠিক পরীসংখ্যান তুলে ধরা হচ্ছেনা, অথবা পরীসংখ্যানের সাথে বাস্তবের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। একদিকে ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের ফানুস উড়াচ্ছে অন্যদিকে প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলোতে নেতিবাচক প্রবণতা ক্রমে সংকটজনক অবস্থায় উপনীত হচ্ছে। উপরন্তু গার্মেন্টস রফতানীতে দেশের অবস্থানকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। দেশের সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক রফতানীখাতকে একটি অবশ্যম্ভাবি ঝুঁকির মধ্যে রেখে উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। দেশের তৈরী পোশাক কারখানা ও বাজার রক্ষার্থে প্রথমেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে হবে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা জিইয়ে রেখে অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। বিশেষত: বিপুল সম্ভাবনাময় অ্যাপারেল খাতকে ঝুঁকিমুক্ত করতে, অ্যাকর্ড এলায়েন্সসহ এ খাতের সংস্কারের কাজে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং সরকারকে সমন্বিত শক্ত অবস্থান নিতে হবে। বাংলাদেশের অ্যাপারেল রফতানী খাত নিজস্ব শক্তিতেই দাড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌছেছে। প্রতিষ্ঠিত এ খাতটি এখন শুধুমাত্র সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। ভারতের মত যদি এই খাতে নতুন করে প্রণোদনা দেয়া সম্ভব নাও হয়, এ খাতের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে। গ্যাস- বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহ ঘাটতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার রক্ষায় কারখানার কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি দেশের আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও গণতন্ত্রায়ণের চ্যালেঞ্জ কাজ করছে। ধীরে ধীরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হওয়া গার্মেন্ট শিল্পকে তার সম্ভাবনার জায়গায় নিয়ে যাওয়া খুব বেশী কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন শুধু বিনিয়োগকারিদের যোগ্য প্রতিনিধিত্ব এবং নিরাপদ, স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন