বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ইউরোপের ডেনমার্ক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে একই মহাদেশের সুইজারল্যান্ড ও আইসল্যান্ড। ১৫৭ দেশের এই দীর্ঘ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭০তম। তালিকার সবচেয়ে অসুখী দেশ বুরুন্ডি। সুখী দেশ হিসেবে শীষ যেসব দেশ রয়েছে সেগুলো হলো : ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইডেন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট আপডেট ২০১৬-এর তালিকায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বুধবার ইতালির রোম থেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। দীর্ঘায়ু, দুর্নীতির নি¤œমাত্রা এবং লাইফ স্টাইল নির্বাচনে স্বাধীনতা, সামাজিক সুযোগ ও সহযোগিতা, হৃদ্যতা, সুখ ভোগের বৈষম্যের স্বল্পমাত্রা এবং মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সুখী দেশগুলোর এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবকল্যাণের সঠিক মূল্যায়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য, আয় এবং সুশাসন পৃথকভাবে পরিমাপের চেয়ে মানুষের সুখ পরিমাপই উন্নততর মাপকাঠি হতে পারে। বলা হয়, সামাজিক অগ্রগতি এবং সরকারি নীতির লক্ষ্য হিসেবে সুখ একটি সঠিক মাপকাঠি হিসেবে দিন দিন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের একটি সূচক প্রকাশ করেছে বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের ইনটেলিজেন্স ইউনিট। ২০১৫ সাল পর্যন্ত জরিপকৃত ইকোনমিস্টের ওই রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ক্যানাডার অন্যতম শহর মন্ট্রিয়েলের সমান, যদিও জীবনযাত্রার আনুষঙ্গিক সুবিধাবলি মন্ট্রিয়েলে অনেক বেশি। কানাডার বৃহত্তম শহর টরন্টোর জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশের জীবনযাত্রার ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ আমেরিকার মেক্সিকো সিটি, ক্লিভল্যান্ড এবং তুরস্কের ইস্তা¤ু^লের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। ইংল্যান্ডের ইকোনমিস্ট পত্রিকায় পৃথিবীর ১৩৩টি নগরীর ওপর এই জরিপ চালানো হয়। এই জরিপে যে দুটি বিষয়কে বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয় সেগুলো হলো, ডলারের আনুপাতিক শক্তি এবং প্রবাসীদের জীবনযাত্রার ব্যয়। জরিপকৃত ১৩৩টি দেশের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান ৭৭ নম্বর। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের দিক দিয়ে পৃথিবীতে যে ১০টি দেশের ব্যয় সবচেয়ে কম তার ৪টি অবস্থিত ভারতে। দেশগুলো হলো ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, চেন্নাই এবং নয়াদিল্লি। সবচেয়ে কম জীবনযাত্রার ব্যয়ের নিরিখে পাকিস্তানের করাচি মহানগরীর অবস্থান ৭ম স্থানে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম কমে যাওয়ায় এবং ডলারের তুলনায় স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সংশোধনের ফলে রিও ডি জেনিরো শহরের অবস্থান অনেক ওপরে উঠে এসেছে। এখন শহরটির অবস্থান ৫০ নম্বরে, অর্থাৎ সেখানেও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কমে গেছে।
আলোচ্য রিপোর্ট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি হ্রাসের বেলুনকে ফুটো করে দেয়। এই তো কিছু দিন আগেও বড় গলা করে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। সরকারদলীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বড়াই করে বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি এখন উন্নয়নের রোল মডেল। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৪ ডলার হওয়ায় সরকারের প্রচারবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে। অনেক পরিবারেই এখন একাধিক গাড়ি রয়েছে। তাদের অন্ন ও বস্ত্রের মানও উন্নত হয়েছে। তারা শুধু এখন এইটুকু বলাই বাকি রেখেছে যে, বাংলাদেশে এখন দুধ ও মধুর নহর বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটি কী? পৃথিবীর অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ শহর মন্ট্রিয়েলের জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় সমান দেখানো হলেও বাস্তবে ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় কিন্তু মন্ট্রিয়েলের চেয়ে বেশি। কারণ মন্ট্রিয়েলের এবং সেই সুবাদে নিউইয়র্ক, টরন্টো, সিডনি, ক্যানবেরা প্রভৃতি উন্নত শহরে সরকারের তরফ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সেগুলো ঢাকায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন মন্ট্রিয়েলসহ উন্নত দেশ এবং তাদের শহরগুলোতে যে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়, সেটি বলতে গেলে প্রায় ফ্রি। সেখানে ডাক্তাদের ফি যেমন দিতে হয় না, তেমনি ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ওষুধপত্রের খরচও সরকার বহন করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বা ক্যানবেরায় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সেই সন্তানের একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চাইল্ড কেয়ার একটি বড় অঙ্কের মাসিক ভাতা দেয়। ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় ১০ লাখ বা ২০ লাখ বা ৩০ লাখ টাকা যদি কোনো সার্জিক্যাল অপারেশন হিসেবে ব্যয় করা হয়, তাহলে তার ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্য বীমা তথা সরকার বহন করে থাকে। পক্ষান্তরে ঢাকায় বর্তমানে ভালো ডাক্তারের ফি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। তারপর রক্ত, মল, মূত্র ইত্যাদি পরীক্ষার পেছনে ব্যয় হয় কম করে হলেও ৫ হাজার টাকা। ওষুধপত্রের পেছনে ব্যয় হয় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এসবের কোনোটিতেই সরকার এক পয়সাও বহন করে না। ল্যাবএইড বা স্কয়ারে পিত্তথলির পাথর অপসারণের জন্য যে মাইনর অপারেশন করতে হয় সেজন্যেও ব্যয় হয় অন্তত ৫০ হাজার টাকা। এখানেও সরকার ১ পয়সা খরচ বহন করে না। ওইসব দেশে গৃহনির্মাণ ঋণের অথবা মোটরগাড়ি ক্রয়ঋণের সুদের হার মাত্র ৩ শতাংশ। ঢাকায় সেটি ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাস্তব ক্ষেত্রে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ওইসব দেশ বা নগরীর চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকা মহানগরীকে বাসযোগ্য করতে হলে অথবা এখানকার জনজীবনকে সুখী ও শান্তিময় করতে হলে উন্নত দেশগুলোতে যেসব সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সেগুলো সাধ্যমতো বাংলাদেশেও চালু করা উচিত। এইসব সুযোগ-সুবিধাকে বলা হয় সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি তখনই সার্থকতা বহন করবে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে এবং তার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাও সাধ্যমতো প্রবর্তিত হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন