গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বর্ষণে রাজধানী ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার হয়। রাস্তাঘাট ও নিম্নাঞ্চল হাঁটু থেকে কোমরপানির নীচে চলে যায়। জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যান ও জন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় নৌকা ও বোট চলাচলের যে ছবি ছাপা হয়েছে তাতেই অনুধাবন করা যায় পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করে। অবশ্য জলাবদ্ধতার শোচনীয় শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রাজধানীবাসীর এই প্রথম নয়। এটা এখন অনেকটাই নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রাজধানী শহরের এই দুরবস্থা দু:সহ ও কল্পনাতীত। এই শহরে সমস্যার কোনো অন্ত নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলাবদ্ধতা। যানজটও একটি বড় সমস্যা। জলজট ও যানজটের এই সমস্যা থেকে রাজধানীবাসী কবে মুক্তি লাভ করবে, কেউ বলতে পারে না। এ দুটি সমস্যার সমাধানে এ পর্যন্ত যত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কোনোটাই কোনো কাজে আসেনি। পরিস্থিতির বরং দিনকে দিন অবনতি ঘটছে। জলাবদ্ধতার সমস্যা ও নাগরিক দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অথচ তা এমন কোনো সমস্যা নয়, যা সমাধানের অযোগ্য। দু’দশক আগেও এমন পরিস্থিতির কথা কল্পনা কেউ করতে পারেনি। বৃষ্টি-বর্ষণে মুষ্টিমেয় কয়েকটি সড়কের কোনো কোনো স্থানে সামান্য পানি জমলেও দুয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা সরে যেতো। এখন প্রায় সর্বত্রই জলাবদ্ধতা এবং দিনের পর দিন তা অব্যাহত থাকছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী-খাল ভরাট করে দখল, পলিথিনের অনিয়ান্ত্রিত ব্যবহার, সংস্কার কাজের সমন্বয়েহীনতা, জলাধার ও নিম্নাঞ্চল দখল করে বাড়িঘর-স্থাপনা নির্মাণ এবং ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজে হয়ে পড়ার কারণেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজধানী শহরের দ্রুত বিস্তার ঘটছে এবং সেই বিস্তারটি ঘটছে অপরিকল্পিতভাবে। পানি নিকাশ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা এই দ্রুত সম্প্রসারণশীল শহরের পানি নিকাশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারছে না। মাত্র ৪০ শতাংশ এলাকায় তার ড্রেনেজ সিস্টেমের আওতায় আছে। বাকী ৬০ শতাংশ এলাকায় পানি নিকাশ হয় প্রাকৃতিকভাবে। এক সময় এই শহরের পানি নিকাশের জন্য অন্তত ৬৫টি খাল ছিল, ছিল চারপাশে নদী। শহরটি ছিল খাল ও নদী বেষ্টিত। এর ভেতরে ছিল আরও জলাধার ও নিম্নাঞ্চল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, খালগুলোর অধিকাংশেরই এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব খাল ছিল পানিতে ভরপুর ও স্রোতস্বিনী। তখন খালে নৌকা চলতো। কিছু খাল ভূমিদস্যু ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দখল করে তাদের অস্তিত্ব বিনাশ করেছে। কিছুখাল সরকার দখল করে ভরাট করে কাজে লাগিয়েছে। জলাধার ও নিম্নাঞ্চলগুলোও একইভাবে উধাও হয়ে গেছে। ফলে পানি নিকাশের প্রাকৃতিক উপায় রহিত হয়ে গেছে। শহরের চারপাশের নদীগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত সংগীন। দখল-দূষণ এবং ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো মরা খালে রূপান্তরিত হয়েছে। খাল ও নদী উদ্ধার এবং সেগুলো সংস্কার করার তাগিদ বহুদিন ধরে উচ্চারিত হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। বহু ঘোষণা ও পরিকল্পনার কথা শোনা গেছে। কিছু উদ্যোগ- পদক্ষেপও নিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তুু দখলকারীরা এতই প্রভাবশালী যে, এসব ঘোষণা,পরিকল্পনা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ কোনো ফল দেয়নি। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, খাল উদ্ধারে দ্রুত অভিযানে নামতে যাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন খালে থাকা অবৈধ স্থাপনার একটি তালিকা করা হয়েছে। অস্তিত্বহীন একটিসহ চারটি খালে ৩২৪টি স্থাপনা সনাক্ত করা হয়েছে। এই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযানের উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। তবে সংশয় আছে, আদৌ এই উচ্ছেদ অভিযান সফল করা যাবে কিনা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকলে অবশ্যই উচ্ছেদ সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের এই প্রতিজ্ঞাই আমরা প্রত্যাশা করি। প্রসঙ্গত আমরা এও বলতে চাই, শুধু চারটি নয়, দখল হয়ে যাওয়ার প্রতিটি খালই উদ্ধার করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আরেক খবরে জানা গেছে, গাজীপুরে তুরাগ নদী দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনার একটি তালিকা হাইকোর্টে জমা দিয়েছে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি। কমিটির তরফে অবিলম্বে ওইসব স্থাপনা সরিয়ে ফেলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করি, স্থাপনাগুলো উচ্ছেদে তরিৎ পদক্ষেপ নেয়া হবে। এই সঙ্গে বুড়িগঙ্গাসহ অন্যান্য নদী করে দখল নির্মিত স্থাপনা উচ্ছেদেরও ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে খাল-নদী উদ্ধারের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়ার কথা বিবেচনায় নিতে হবে।
খাল ও নদীগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে সচল করা সম্ভব হলে রাজধানীর পানি নিকাশ ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসবে, তাতে জলাবদ্ধতার অভিশাপে কেটে যাবে বলে আশা করা যায়। এই সঙ্গে ঢাকা ওয়াসাকে আরও শক্তিশালী ও কার্যক্ষম করে তুলতে হবে। গোটা শহরকে তার ড্রেনেজ সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। ড্রেনগুলো বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে। গত ৪০ বছরে এই ড্রেনেজ সিস্টেমের কোনো উন্নতি হয়নি। ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের সংস্কার হয়নি; তা পরিষ্কার-পরিচ্ছিন্নও করা হয়নি। বৃষ্টির পানি যাওয়ায় জন্য যে তিনশ’র মতো ড্রেন আছে সেগুলোর তলানিতে কঠিন বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য জমা হয়ে শক্ত হয়ে গেছে। এগুলো পরিষ্কার করা দরকার। আড়াই হাজার ক্যাচপিটের প্রায় এক হাজার নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলোও সংস্কার ও সচল করতে হবে। দ্রুত পানি নিকাশের জন্য যে বক্সকালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, তাও তেমন কাজে আসছে না। এর বিবিধ কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো, ভুল নকশায় এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। কেন এমন হয়েছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। মোটকথা, দ্রুত পানি নিকাশের জন্য ওয়াসাকে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ওয়াসাকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। উল্লেখ আবশ্যক যে, জলাবদ্ধতার জন্য এই শহরের অধিবাসীরাও কম দায়ী নয়। তারা অসচেতনভাবে বা সিভিক সেন্সের অভাবে ময়লা-আর্বজনা বিশেষ করে পলিথিন ব্যাগ ড্রেনসহ যত্রতত্র ফেলে দেয়। ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়ার এটা একটা বড় কারণ। এ ব্যাপারে তাদের সচেতন হতে হবে। যথাস্থানে ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন ব্যাগ ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমরা তাদের সর্বোচ্চ সচেতনতা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন