অপরাধ দমন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের। এ জন্য পুলিশ বাহিনীর নানা শাখায় প্রয়োজনীয় জনবল ও প্রযুক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের বিশেষ এলিট ফোর্স হিসেবে র্যাব যেমন আছে তেমনি ডিবি বা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চও সক্রিয় আছে। কিন্তু সরিষার ভেতরে ভূত থাকলে ভুত তাড়ানোর কোন ফর্মূলাই কাজ করেনা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় গুম-খুন অপহরণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াকে যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জননিরাপত্তার সংকট হিসেবে গণ্য হচ্ছে, এর ফলে বিনিয়োগ, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে দেশের ভাবমর্যাদা ও আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তখন গুম-অপহরণের মত ঘটনার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেনীর সদস্যের জড়িত থাকার ঘটনা ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কক্সবাজারে ব্যবসায়ীকে আটক করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ১৭ লাখ টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়ার পর টাকাসহ ৭ ডিবি সদস্য সেনাসদস্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ডিবি সদস্যরা স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল গফুরকে আটক করে প্রথমে কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবী করে,অন্যথায় তাঁকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার ভয় দেখায়। তার প্রাণ বাঁচাতে দরকষাকষির পর পরিবারের সদস্যরা ডিবির হাতে নগদ ১৭ লাখ টাকা পৌছে দিলে গফুরকে টেকনাফের মেরিণড্রাইভ এলাকায় ছেড়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় ডিবি সদস্যরা। তবে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর গফুরের ভাই ঘটনার শুরুতেই বিষয়টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনাক্যাম্পে জানায়। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়কারি ডিবি সদস্যরা টাকাসহ সেনাসদস্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর উদ্ধারকৃত টাকা ভিকটিম পরিবারকে ফেরত দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
গত ৫-৭ বছরে অসংখ্য গুম-অপহরণ, অপমৃত্যু ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনার সাথে কথিত ডিবি পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদাপোশাকধারি ব্যক্তিদের নাম এসেছে। কিছু ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা প্রমানীত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। অথচ এসব ঘটনার সাথে কারা জড়িত এবং অপরাধিদের ধরে আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই দায়িত্ব। বিশেষত: ডিবি পুলিশের কাজই হচ্ছে দুর্ধর্ষ অপরাধি ও গোপণে বেআইনী তৎপরতায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। ডিবিতে অনেক সৎ ও চৌকষ অফিসার রয়েছেন, অপরাধ দমনে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা যথেষ্ট আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করতে সক্ষম। তবে ডিবি’র অপরাধপ্রবণ সদস্যদের হাতে ক্রমবর্ধমান হারে গুম-অপহরণ ও অপমৃত্যুর অভিযোগের কারণে পুরো বাহিনীর প্রতি মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্ক তৈরী হয়েছে। গুম-অপহরণ বন্ধের জন্য সাধারণ মানুষ যে সব বিশেষায়িত বাহিনীর স্মরণাপন্ন হয়, সে সব বাহিনীর সদস্যরাই যদি গুম-অপরণ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার বা পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোন উপায়ই অবশিষ্ট থাকেনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অপরাধমূলক তৎপরতাকে কাজে লাগাচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধিরা। তারা র্যাবের পোশাক পরে কিংবা ডিবির পরিচয়ে লোকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা বা রাজনৈতিক কারণেও গুম-অপহরণের শিকার হয়ে গত কয়েক বছরে শত শত মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। সাদাপোশাকের ডিবি’র দ্বারা অপহৃত হওয়ার অভিযোগের পর বেড়িবাধে, নালা-ডোবা বা নদীতে লাশ হয়ে পড়ে থাকার অনেক উদাহরণ আছে। এভাবেই ডিবি পুলিশ এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব বিষয়ে কার্যত নিস্ক্রিয় থাকলেও কখনো কখনো সাধারণ মানুষের হাতেও ধরা পড়ছে সংঘবদ্ধ অপরাধিরা। গত সপ্তাহে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে ৫ ভুয়া র্যাব সদস্যকে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। এ সপ্তাহে ফরিদপুরের একজন এসপি’র ব্যাংক একাউন্টে সাড়ে কোটি টাকার খোঁজ পেয়েছে দুদক, যা তার আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এমন শত শত সদস্য রয়েছে। তবে বেসামরিক শাসনে সেনাসদস্যদের হাতে ডিবি পুলিশ আটক হওয়ার ঘটনা একটি বিরল ব্যতিক্রম। নতুন করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর পদভারে এমনিতেই কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকায় এক প্রকার যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এই জাতীয় সংকট মোকাবেলায় দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা, আশ্রয় নির্মান, শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। তখন অপরাধ দমনে নিজেদের দায়িত্ব পালনের বদলে একশ্রেনীর পুলিশ ও ডিবি সদস্য নিজেরাই ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক কারণে হত্যা, গুম খুনসহ নারায়ণগঞ্জের সাতখুন মামলায় এলিটফোর্স র্যাবের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ঘটনা থেকে এমনিতেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশে অনাস্থার শিকার হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও দুর্নাম ও চাপের মুখে রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হওয়ায় সেখানে ডিবি’র হাতে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আবারো আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হল। ঘটনাচক্রে ডিবির এই সদস্যরা সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ায় তাদের বিরুদ্ধে হয়তো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এমন বহু অপরাধী সদস্য রয়েছে যাদেরকে খুঁেজ বের করার কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা পুন:প্রতিষ্ঠার করতে প্রথমেই ডিবি পুলিশের সর্বস্তরে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। সেই সাথে বাহিনীকে দল ও রাজনীতি নিরপেক্ষ, জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অপহরণকারি ডিবি সদস্যদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে সেনাসদস্যরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তার জন্য আমরা তাদের অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন