রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট তথ্য-প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা নিখোঁজ হয়েছেন। ৩৬ ঘণ্টা পরও তার পরিবার তার কোনো সন্ধান পাচ্ছে না। তার স্ত্রী ডা. কামরুন্নাহার চৌধুরী দাবী করেছেন, জোহাকে অপহরণ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বুধবার জোহা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে তার সাথে কথা হয়। এর আগে দু’দিন তিনি বাসায় ফেরেননি। এর কারণ তার পরিবারের সদস্যরা জানেন না। তারা জানান, অফিস থেকে বের হওয়ার পর জোহা সিএনজিতে ওঠেন। কচুক্ষেত এলাকায় দুই-তিনটি গাড়ি তার সিএনজিকে ঘিরে ধরে। এরপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জোহার স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, গত বৃহস্পতিবার কাফরুল, ক্যান্টনমেন্ট ও কলাবাগান থানায় দফায় দফায় গিয়ে জিডি করতে চাইলে কোন থানাই জিডি নেয়নি। কাফরুল থানার ওসি জানিয়েছেন, তার এলাকায় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই জিডি নেয়া হয়নি। কলাবাগান থানার ওসি জানিয়েছেন, জিডি করতে কেউ আসেনি। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান বলেছেন, আমরা শুনেছি, তবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহাকে গ্রেফতার করতে পারে, তবে আমি নিশ্চিত নই। তানভীরের সন্ধান না পেয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। জোহার স্ত্রী গত বৃহস্পতিবার তার কলাবাগানের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, জোহা সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থেকে দেশের জন্য কাজ করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার কাছে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে যখনই কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, তখনই তিনি তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, আমি ভয়ভীতির মধ্যে আছি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এটা কেমন কথা, একটা লোক নিখোঁজ হয়েছেন, অথচ থানায় কোনো জিডি নেয়া হচ্ছে না।
এটা বড়ই দুঃখের কথা, একজন লোক নিখোঁজ হয়েছেন এবং তার পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করতে গেলে তা নেয়া হয়নি। অথচ যে কোনো নাগরিক নিখোঁজ বা নিরুদ্দেশ, অপহৃত হলে তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব ও কর্তব্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এক্ষেত্রে একজন তথ্য-প্রযুক্তিবিদ এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের স্থগিত থাকা সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের ডিরেক্টর (অপারেশন) এবং রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক অনানুষ্ঠানিকভাবে যার সহযোগিতা নেয়, এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি অধিক গুরুত্বসহকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেয়া উচিত ছিল। অথচ উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা শৈথিল্য প্রদর্শন ও বিভিন্ন অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান হয় যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। অবশ্য অপহৃত হওয়ার অগেই জোহা তার শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি নিয়ে প্রকৃত তথ্য সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রকাশ করায় একটি মহল আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাই তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা তদন্ত সহায়তা থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। কারণ, আমি অনেক বিষয়েই প্রশ্ন তুলেছি। তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছি।’ পত্র-পত্রিকায় সূত্রের উল্লেখ করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জোহা রিজার্ভ কেলেঙ্কারি তদন্তে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্থানার দেয়া অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। জোহার সঙ্গে প্রথম থেকেই তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে অমিল হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালটেন্ট রাকেশ আস্থানার। তার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি রাকেশ। জোহা সংবাদ মাধ্যমকে এ কথাও বলেছেন, ‘এ ঘটনার আগে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার আমন্ত্রণে জঙ্গি তৎপরতাসহ সাইবার অপরাধের বড় বড় ঘটনা তদন্তে সহায়তা করেছি। তখন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এখন একটি মহলের স্বার্থে আঘাত লাগায় তারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।’ অপহৃত হওয়ার আগে জোহার এসব বক্তব্যে কোনো প্রভাবশালী মহল হয়তো ক্ষুব্ধ হয়েছে। ধারণা করা অমূলক নয়, তার এসব কথাবার্তা যদি চলতে থাকে, তাহলে থলের অনেক বড় বেড়াল বের হয়ে আসতে পারে। যা হোক, অপহরণ করা হোক বা নিরুদ্দেশ হোক, জোহা একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এটাই এখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ কেলেঙ্কারির তথ্যপ্রযুক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতি উদঘাটনের ক্ষেত্রে জোহা যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমেই তার সহযোগিতা নিয়েছিল। তারপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার যুক্তি তুলে ধরে জোহা বক্তব্যও দিচ্ছিলেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই বক্তব্যই তার জন্য হয়তো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার নিরুদ্দেশের সাথে এর সম্পৃক্ততা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। জিডি গ্রহণ, মামলা হওয়া এবং যথাযথ তদন্ত হলে নিশ্চয়ই এর কূল-কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। জোহা একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি একজন নাগরিক। যে কোনো নাগরিক অপহৃত, নিখোঁজ, নিরুদ্দেশ যাই হোক না কেন, তার স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে সহায়তা প্রার্থী হয়, তবে তাদের সহায়তা পাওয়া নাগরিক অধিকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সহায়তা প্রদান করতে বাধ্য। আমরা মনে করি, জোহার স্ত্রী’র দাবী অনুযায়ী জোহার অপহরণ বা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করবে। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন