টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবকাঠামোখাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও ইউএনডিপির যৌথ আয়োজনে ‘ইম্প্যাক্ট বাংলাদেশ ফোরাম-২০১৭’এর অনুষ্ঠানমালার অন্যতম বিষয় ছিল, ‘প্রবৃদ্ধি ও এসডিসির জন্য অবকাঠামো নির্মাণ।’ ‘বিষয়টির আলোচনায় বক্তরা বলেছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বছরে অন্তত ১২.৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে যদি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি থেকে কাঙ্খিত ফায়দা হাসিল করতে হয়। বর্তমানে এখাতে প্রতিবছর ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এই ব্যয়ের ৯০ শতাংশ করে সরকার। এক্ষেত্রে বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য তারা তাকিদ দিয়েছেন। পিপিপির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তারা বলেছেন, পিপিপি হতে পারে উপযুক্ত মাধ্যম। অবকাঠামো উন্নয়ন ও ম্যানেজমেন্টের বিদ্যমান প্রক্রিয়ার আশু পরিবর্তনেরও তারা দাবি জানিয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ বিশ্বে এখন ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে তার ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে হলে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের অবশ্যকতা প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ স্থলে তার অবস্থান। এশিয়ার এই দুই অংশের সঙ্গে যোগাযোগ ও আর্থবাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যম হতে পারে বাংলাদেশ। এ জন্য উপযোগী ও টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই তার।
উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে সরকার অবকাঠামো উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিলেও এখাতে বার্ষিক বরাদ্দ মোটেই সন্তোষজনক নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নয়ন বাজেটের অন্তত ৫ শতাংশ এখাতে বরাদ্দ দিলে উন্নয়ন দ্রæতায়িত হবে। সরকার অভ্যন্তরীন উৎস ছাড়াও বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ভালো সাড়াও আছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চসুদ ও অন্যায়-অযৌক্তিক শর্তে সরকার ঋণ নিচ্ছে। এটা হিতে বিপরীত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে, যার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে এবং কিছু বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। সড়ক, সেতু, রেল, বন্দর উন্নয়নে নেয়া প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজে বাড়তি সময় ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও দেখা গেছে, যান চলাচলের জন্য মহাসড়ক দুটি যথেষ্ট উপযোগী হয়ে ওঠেনি। কাজের নিম্নমানের কারণে অল্পদিনেই ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে। অন্যান্য সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ বা সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই চিত্র প্রত্যক্ষ করা গেছে। সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসাবে চিহ্নিত পদ্মাসেতু প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে। নতুন করে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা চালু হবে কিনা এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ অতীব প্রয়োজনীয় হলেও এক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন নেই। সবেমাত্র পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মংলা বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগের বিষয়টি এখনো কাগজে-কলমেই আটকে আছে। চট্টগ্রাম ও মংলা মন্দরের উন্নয়নের জন্য অনেক বড় বড় প্রকল্পের কথা শোনা গেছে। সে সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে ধীর গতিতে। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজটও কন্টেইনার জট পর্যন্ত নিরসন করা সম্ভব হয়নি। স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়নে কিছু কাজ হয়েছে বটে, তবে সেটা ভারত থেকে পণ্য আমদানি করার জন্যই মূলত। অকাঠামো উন্নয়ন খাতের প্রকল্পগুলোর সময়মত বাস্তবায়ন না হওয়া, বাজেট বা ব্যয় বৃদ্ধি এবং কাজ মানসম্মত না হওয়ার মূল কারণ দুর্নীতি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু অবকাঠামোই নয়, অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বস্তুত উন্নয়নের নামে সরকারী অর্থের চলছে বেপরোয়া লুটপাট। সরকারের অর্থ মানে জনগণের অর্থ। আবার সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে যে ঋণ আনছে তারও দায় চাপছে জনগণের ঘাড়ে। এই অর্থ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সরকার-অনুগত ঠিকাদাররা লুটপাট করে খাবে, এটা কোনো বিবেচনাতেই বরদাশতযোগ্য হতে পারে না।
অবকাঠামো উন্নয়নে বছরে ১২.৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেই কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়ে যাবে, এই প্রেক্ষাপটে, সেটা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। এই অর্থও যে লুটপাট হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কি? কাজেই সর্বাগ্রে দুর্নীতি, অপচয় ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন যথাসময়ে সম্পন্ন করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। একই সঙ্গে কাজের মান আন্তর্জাতিক মানের সমান হতে হবে। এটা অবশ্যই খুব কঠিন কর্ম, বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষিতে। কিন্তুু লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যত কঠিনই হোক, তা করতে হবে। অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারী খাতকে আরও ভালোভাবে এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। পিপিপি এক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য উপায় বটে; কিন্তুু পিপিপির অতীত চিত্র মোটেই উৎসাহজনক নয়। এ বিষয়ে কোথায় কি ধরনের বাধা বা সমস্যা আছে তা দূর করতে হবে। আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া জরুরি। যে ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। জবাবদিহিতা ও মনিটারিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে এবং রক্ষণ ব্যবস্থার সঙ্গে বিশেষজ্ঞ কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারী খাতকে সংযুক্ত করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, সকল উন্নয়ন কাজের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য পূর্বশত হিসাবে বিবেচিত। বর্তমানে এর অভাব আছে এবং বিগত কয়েক বছর ধরেই তা বিদ্যমান রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এর অবনতি ঘটার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল। সঙ্গতকারণেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কায়েম করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন