সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন চলতি মাসেই করা হচ্ছে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পুনর্বিবেচনার আবেদনে আপিল বিভাগের দেওয়া পুরো রায় নিয়েই প্রশ্ন তোলা হবে বলেও জানান তিনি। গতকাল সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের বিষয়ে দেড় ঘণ্টার এক বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের একথা জানান। এর আগে ২০ অক্টোবর ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের রিভিউ এর প্রস্তুতির জন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে সংবিধানে আনা ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে ৭ সদস্যের আপিল বিভাগ দেশে গণতন্ত্র, সংসদ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করে, যা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে বলে ক্ষমতাসীনদের দাবি। অবশ্য প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বরাবরই দাবী করছেন রায়ে এবং পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে কোথাও খাটো করা হয়নি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় নিয়ে সংসদ ও সরকারের মন্ত্রীদের বিক্ষুব্ধ তীব্র প্রতিক্রিয়া, আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের আন্দোলনের প্রেক্ষক্ষাপটে রায় প্রদানকারী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান। বিদেশ থেকে ফিরে এসে আবার হঠাৎ করে তাঁর এক মাসের ছুটি নেয়ার রহস্য নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। আইনমন্ত্রী দাবি করেন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আবেদন করেই প্রধান বিচারপতি ছুটি নিয়েছেন। তিনি আবার কাজে যোগদান করবেন। অ্যাটর্নী জেনারেল বিপরীত মেরুতে গিয়ে বলেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার আবার নিজ চেয়ারে ফিরে আসা সুদূর পরাহত। এর আগে প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ আপিল বিভাগের চারজন সিনিয়র বিচারপতিতে বঙ্গভবনে ডেকে তাদের হাতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ১১টি অভিযোগ সম্বলিত একটি চিঠি ধরিয়ে দেন। দেশের সাংবিধান বিশেষজ্ঞরা হঠাৎ করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এই অভিযোগ তদন্তের দুর্নীতির দমন কমিশনের এক্তিয়ার নেই। অবশ্য আইনমন্ত্রী দুদদক তদন্ত করবে এমন কথাই জানিয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে জাতীয় সংসদ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এমপিরা। প্রধান বিচারপতি এস সে সিনহাকে পাকিস্তানের এজেণ্ট হিসেবে অবিহিত করে তার পদত্যাগ দাবী করা হয়। অন্যদিকে রায়ের পর্যবেক্ষণ সংশোধনের চেষ্টায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বৈঠকের পর বৈঠক করা হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছুঁটে যান প্রধান বিচারপতির কাকরাইলের বাসায়। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা দেখা করেন এস কে সিনহার সঙ্গে। এমনকি এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়। সরকারের এতো উদ্যোগ এবং চেস্টার পরও এস কে সিনহা নিজের অবস্থানে অনড় থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণ ‘অপ্রাঙ্গিক বিষয় বেশি এসেছে’ অভিযোগ করেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এম খায়রুল হক। অবশ্য বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধেও তত্ত¡াবধায়ক সরকার বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণে অহেতুক বিষয়ের অবতারণার অভিযোগ ছিল। এমনকি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে থেকে সরকারি সুবিধা নিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক উঠে। ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও নেতাদের এমন আচরণে ভারতের মিডিয়াগুলো ‘প্রধান বিচারপতি হওয়ায় এস কে সিনহা সংখ্যলঘু হওয়ায় তা বিরুদ্ধে বিয়োদগার হচ্ছে’ প্রচারণা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতা, আইনজীবী ও মন্ত্রী-এমপিদের আশ্বস্ত করে সংসদে আইনমন্ত্রী রায় রিভিউয়ের আবেদন করবেন জানিয়ে বলেছিলেন, রিভিউয়ে আমরা ‘কামিয়াব’ হবো।
এটর্নি জেনারেলের সাথে বৈঠকের পর গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমরা বসেছিলাম ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের গ্রাউন্ডগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য। আমরা গ্রাউন্ডগুলো ফাইনালাইজ করেছি। এখন দাখিল করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ মাসের মধ্যেই রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হবে। রিভিউ করব, তার মানে পুরো রায়কেই প্রশ্ন করছি।
বৈঠকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ছাড়াও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মমতাজ ফকির, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, একরামুল হক টুটুল, অমিত তালুকদার, বিশ্বজিৎ দেবনাথ, খন্দকার দিলীরুজ্জামান, মাসুদ হাসান চৌধুরী, সরদার রাশেদ জাহাঙ্গীর ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
গত ২০ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রিভিউ আবেদন করতে সহকর্মীদের নিয়ে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল তাদের নিয়েই বৈঠকটি হয়েছে। বৈঠক শেষে মাহবুবে আলম বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে এ মাসেই রিভিউ করা হবে। এরপর ১১ অক্টোবর রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার কথা জানান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আইন অনুযায়ী, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে হবে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ৭৯৯ পৃষ্টার পূণাঙ্গ রায় গত ১ অগাস্ট প্রকাশ করে হাইকোর্ট। ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ফলে মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। অতপর সে বিল সংসদে পাস হয়। উল্লেখ আগামী ১০ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি এস সে সিনহার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন