রাজধানীতে সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্য চলছেই। নগরীতে চলাচলকারী ৯৬ শতাংশ বাসে সিটিং সার্ভিসের নামে এখনও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গতকাল রোববার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী বন্ধে’- করনীয় শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, নগরীর যাত্রীরা বাস-মিনিবাসে সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছে। ভাড়া নৈরাজ্য ও পিকআওয়ারে দরজা বন্ধ করে বাসচলাচলের কারনে মাঝপথের যাত্রীরা রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও গাড়ি পায়না। একই দূরত্বে একেক বাসে একেক হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার বাসের গায়ে সিটিং সার্ভিস লিখে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দিগুণ, তিনগুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রীও বহন করা হচ্ছে। সিটিং বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহনের কারনে যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের সাথে প্রায়শ বচসা, হাতাহাতি-মারামারি ঘটনাও ঘটছে। কিছুদিন যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও প্রশাসন, মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, বিআরটিএ বা পুলিশ কারো কোন সহযোগিতা না পেয়ে এক সময় এই নৈরাজ্যর কাছে যাত্রীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
আলোচনা সভায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকা মহানগরীর যাত্রী সাধারণের দীর্ঘদিনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ৫ সদস্যের একটি টিম গত তিন মাসব্যাপী নগরীতে চলাচলরত ১০৩০টি বাস-মিনিবাসের যাত্রী সেবা, গাড়ীর অবস্থা, ভাড়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে। পাশাপাশি চালক, হেলপার, যাত্রী, মালিক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিআরটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারীভাবে বাস ও মিনিবাসে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। ঢাকা মহানগরীতে বাস ভাড়া (ব-সিরিজ) প্রতি কি.মি. ১ টাকা ৭০ পয়সা, মিনিবাস ভাড়া (জ-সিরিজ) প্রতি কি.মি. ১ টাকা ৬০ পয়সা। সর্বনিন্ম ভাড়া ৩ কি.মি. পর্যন্ত বড় বাসে ৭ টাকা, মিনিবাসে ৫ টাকা হলেও নগরীতে চলাচলরত ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়া বা সর্বনি¤œ ভাড়া কিছুই মানেন না। নামমাত্র কিছু বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়না। বিভিন্ন বাস কোম্পানি তাদের পরিবহনের জন্য কোম্পানি প্রণীত ভিন্ন ভিন্ন ভাড়ার চার্ট অনুসরণ করে ভাড়া আদায় করছে। অথবা বাসে উঠার সময় হেলপারের মুখে উচ্চারিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এই কারনে সরকারের ভাড়া নির্ধারণে আইন চরমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন বলে দাবী করেন তিনি।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, বিআরটিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান, ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ, দৈনিক সমকালের সহযোগী সম্পাদক ও সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য বন্ধে সরকার গঠিত কমিটির সদস্য অজয় দাশ গুপ্ত, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল আলম তালুকদার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্নয়ক জোনায়েদ সাকি, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হিরু, সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক হারুন অর রশিদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট এর নারী বিষয়ক সদস্য শামসুন্নাহার প্রমূখ।
বিআরটিএ এর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, বিআরটিএ’র আইনে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছুই নেই। মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এইসব বিষয় আবিস্কার করেছে। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের জিডিপি’র ৩৭ শতাংশ ঢাকা থেকে উৎপাদিত হয়। অথচ ঢাকা যানবাহনের গতি দিনদিন কমছে এই কারনে জাতীয় উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে। সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য বন্ধে সরকার গঠিত কমিটির সদস্য সাংবাদিক অজয় দাশ গুপ্ত বলেন, আমরা জানি মালিক-শ্রমিক মানে তেল আর পানি, তারা কখনো এক হবার নয়। কিন্তু পরিবহন সেক্টরে মালিক-শ্রমিক নেতারা তাদের কায়েমী স্বার্থের জন্য দুধ আর পানি হয়ে যায়। এতে যাত্রী হয়রানী ও ভাড়া নৈরাজ্য বাড়ে।
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য বন্ধে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়ায়, নির্ধারিত স্টপেজ অনুযায়ী সিটিং সার্ভিস বাস চালাতে হবে। ভাড়ার অংক ও দূরত্ব উল্লেখ করে টিকিট দিয়ে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে। মালিকদের মর্জি মতো ভাড়া আদায় ও স্টপেজ নির্ধারণ করা যাবে না। মাঝপথের যে কোন স্টপেজে নামলে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা যাবেনা। মালিকরা চালকদের কাছে দৈনিক চুক্তিতে বাস ইজারা দিতে পারবে না।
প্রতিটি বাসে নিবন্ধনে অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত আসন থাকতে পারবেনা। নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী যাত্রী ও অসুস্থ যাত্রীদের ওঠা-নামায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করতে হবে। ঢাকা শহরের চলাচলরত মোট বাসের ২৫ শতাংশ সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করতে পারে। সিটিং সার্ভিসের বাসের আলাদা কালার থাকতে হবে। নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে মাঝ পথ থেকে যাত্রী নিতে পারবে না। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। রুট পারমিটের শর্তানুযায়ী চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
যাত্রী সেবার মানোন্নয়নে সরকার-মালিক-শ্রমিক-যাত্রী প্রতিনিধির সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন হলো নির্দিষ্ট সময় পরপর গণশুনানির আয়োজন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন