বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আমরা কি খাচ্ছি?

| প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খোলা ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সয়াবিন ও সরিষার তেলের প্রায় ৯৫ শতাংশই নিম্নমানের। ঘি শতভাগ নিম্নমানের। রাজধানীর স্কুল-কলেজের সামনে বিক্রী হওয়া ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, ফুসকা ও আচারের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশেই উপস্থিত রয়েছে ই-কোলাই। নুডলস ও সেমাইয়ে রয়েছে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম প্রোটিন। ফুলকপি, বেগুন, সিম, কাঁচামরিচ ও টমেটোর ১৫০টি নমুনার মধ্যে ৪৫টিতেই রয়েছে বিভিন্ন প্রকার পেস্টিসাইডের উপস্থিতি। এই ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে ‘মনিটারিং অ্যান্ড কমোডিটিজ ফর কেমিক্যাল কণ্টামিনেশন অ্যান্ড মাইক্রোরায়োলজিক্যাল অ্যাট এনএফএসএল : এন অ্যাপ্রাইজাল অব ফুড সেফটি সার্ভে ইন বাংলাদেশ-সেকেন্ড রাউন্ড’ শীর্ষক এক জরিপে। ৪৬৫টি নমুনার গুণগত মান পরীক্ষা করে এই তথ্য মিলেছে। জরিপের এই ফলাফলে সঙ্গতকারণেই, ‘আমরা কি খাচ্ছি,’ এমন একটি প্রশ্নের মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে আমরা সবাই। এর আগেও পরীক্ষায় দেখা গেছে, বাজারে বিক্রী হওয়া খোলা ও বিভিন্ন ব্যান্ডের ভোজ্যতেল মানসম্পন্ন নয়। চটকদার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। নানারকম ভেজাল ও নকল ভোজ্যতেলে বাজার সয়লাব। ঘি’র ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। ঘি নামে যা বিক্রী হচ্ছে, তা মোটেও ঘি নয়। অথচ এই নকল-ভেজাল ভোজ্য তেল ও ঘি উচ্চদামে খরিদ করে ক্রেতারা প্রতারিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ, এই সব নকল-ভেজাল ভোজ্যতেল ও ঘি খেয়ে মানুষ নানারকম দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসা ও রোগ নিরাময়ের জন্যে আয়-উপার্জনের একটা বড় অংশ তাদের ব্যয় করতে হচ্ছে। একইভাবে বলা যায়, রাজধানীর স্কুল-কলেজের সামনে ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, ফুসকা, আচার প্রভৃতির নামে যা কিছু বিক্রী হচ্ছে, তাও নিম্নমানের, অস্বাস্থ্যকর, বিভিন্ন পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হয়েছে। নুডলস, সেমাইয়ের মানও যথাযথ নয়। এসবের প্রতি শিশুদের বিশেষ টান আছে এবং এগুলো বাছবিচার না করে তারা খাচ্ছে। এতে তারা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষিপ্ত। তারা বিভিন্ন প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনীশক্তি হারাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, হাতে-নাতে প্রমাণ থাকা সত্তে¡ও নকল-ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য এবং খাবার বিক্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। মাঝে-মধ্যে নকল-ভেজালবিরোধী অভিযান হতে দেখা যায় বটে; তবে তা নকল-ভেজাল রোধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
তরিতরকারি ও শাকসবজি উৎপাদনে ক্ষতিকর পেস্টিসাইডের ব্যবহার নতুন নয়। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারও চলছে। কৃষকরা সচেতনে-অসচেতনে এসব ব্যবহার করছে ফসল রক্ষা ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। তারা আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হলেও মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। এও কারো অজানা নেই, যেসব ফল-ফলারী বাজারে বিক্রী হচ্ছে, তারও অধিকাংশই মানসম্পন্ন নয়। কেমিক্যাল দিয়ে এগুলো পাকানো হয়, সংরক্ষণ করা হয়। এতে ফলের খাদ্যগুণ তো তেমন একটা থাকেই না, উপরন্তু কেমিক্যালের বিষ দেহে প্রবেশ করে রোগব্যাধির জন্ম দেয়। বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, কোনো খাদ্যপণ্যই নকল ও ভেজালমুক্ত নয়। চাল, ডাল ডিম, দুধ, শিশুখাদ্য, গোশত, বোতলজাত পানি এমন কি জীবনরক্ষাকারী ওষুধও ভেজালমুক্ত নয়। বস্তুত ভেজাল-নকলের দৌরাত্মে আসল হারিয়ে গেছে। কোন পণ্য নিম্নমানের, কোন পণ্যে অখাদ্য-কুখাদ্যের মিশেল দেয়া হয়েছে, কোন পণ্যে কী ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল দেয়া হয়েছে তা নির্ণয় ও সনাক্ত করার ক্ষমতা ক্রেতাসাধারণের নেই। খাদ্যপণ্যের নিয়মিত মান পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। নকল-ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বিক্রীর দায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অবনতমানের কোনো খাদ্যপণ্য বিক্রী হতে দেখা যায় না। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ও সাবধান। পণ্যের উৎপাদক, বাজারজাতকারী ও বিক্রেতা কেউই কোনো অনৈতিক পন্থা অনুসরণ করে না। ওইসব দেশে কোনো কারণে পণ্যের অবনতমান সনাক্ত হলে বা ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়।
আমাদের দেশে খাদ্যপণ্যের মানের এই অবনতি অত্যন্ত, দুভার্গ্যজনক ও উদ্বেগজনক। এতে জনস্বাস্থ্য শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্বল ও রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কথায় বলে, সবল মানুষ সবল জাতির পরিচায়ক। আর সবল জাতি উন্নত জাতির পরিচায়ক। নকল-ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যগ্রহণের ফলে মানুষের উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। দুর্বল ও রোগাক্রান্ত মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝাস্বরূপ। তাদের চিকিৎসার জন্য যা ব্যয় করতে হচ্ছে তা কার্যত অপচয়ের শামিল। আমরা লক্ষ্য করছি, রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ক্রমাগত বাড়ছে। দেশে উচ্চবিত্তের মানুষের সংখ্যা সীমিত। অধিকাংশই মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবৃত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। বিত্তহীনের সংখ্যাও কম নয়। অথচ তাদের বার্ষিক চিকিৎসা ব্যয় অন্য অনেক দেশের মানুষের তুলনায় বেশী। মানসম্পন্ন খাদ্যপণ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা গেলে যেমন জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধিত হবে তেমনি রোগব্যাধির প্রকোপ কমবে এবং চিকিৎসা খাতের ব্যয়ও হ্রাস পাবে। এমতাবস্থায়, যে কোনো মূল্য নকল-ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্যের দৌরাত্ম্য থেকে দেশ-জাতিকে মুক্ত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যপণ্যের মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করতে হবে। পণ্যের প্রশ্নে জনসচেতনতা যেমন গড়ে তুলতে হবে তেমনি উৎপাদক, বাজারজাতকারী ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন