দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সড়ক মহাসড়ক বেহাল অবস্থায় রয়েছে। সড়ক নির্মানে নিম্নমানের প্রযুক্তি ও মালামাল ব্যবহারের কারণে রাস্তা ভেঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে জনদুর্ভোগ। এহেন বাস্তবতায় যেখানে সড়ক মহাসড়কে যান চলাচলে চালক-মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় লাগাম টানা আবশ্যক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা সেখানে সড়ক মহাসড়ক ও সেতুতে মালবাহী যান চলাচলে ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণের বদলে লোডিং লিমিট প্রায় দ্বিগুন বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ওভারলোডিংয়ের জন্য বিদ্যমান আইনে থাকা জরিমানার ব্যবস্থা প্রত্যাহারের চেষ্টা করছে একটি সংশ্লিষ্ট মহল। গত রবিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ সংক্রান্ত কমিটি যে চারদফা প্রস্তাব পেশ করেছে তা’তে সড়ক ও সেতুতে পণ্যবাহী গাড়ীর সর্বোচ্চ অনুমোদিত ওজন সাড়ে ১৫টন থেকে বাড়িয়ে ২২ টনে উনীত করা, অতিরিক্ত ওজনের জন্য জরিমানা আদায়ের মত সরকারী আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা যায়। ইতিপূর্বে গত ১০ অক্টোবর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়কপথে যান চলাচলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বা নীতিমালা সংশোধনের ঘোষনা দেন। সে প্রেক্ষিতে তার হাতে গঠিত কমিটি যে সব সুপারিশ করেছে তা’ দেশের সড়ক-মহাসড়ক ও সেতুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও সিড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করেই এসব প্রস্তাব গ্রহন করতে যাচ্ছে সরকার। কমিটির আগামী সভায় প্রস্তাবসমুহ মন্ত্রনালয়ের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে গতকাল প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়।
বিশ্বের সবচে ব্যয়বহুল সড়ক, মহাসড়ক, সেতু ও উড়ালসেতু বাংলাদেশে নির্মিত হলেও এসব অবকাঠামোর মান তুলনামূলকভাবে অনেক খারাপ। প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে জানা যায়, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতি কিলোমিটার চারলেন নতুন মহাসড়ক নির্মানে খরচ হয় ২৮ কোটি টাকা, ভারতে ১০ কোটি এবং চীনে ১৩ কোটি টাকা, সেখানে বাংলাদেশে ব্যয় হয় গড়ে ৫৯ কোটি টাকা। যতই দিন যাচ্ছে এ ব্যয় আরো বেড়ে চলেছে। পদ্মাসেতুর সংযোগ সড়ক হিসেবে ঢাকা-মাওয়া চারলেন রাস্তার নির্মান ব্যয় প্রতি কিলোমিটার ৯৫ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়েছে। প্রাথমিক প্রাক্কলিত ব্যয় মেয়াদশেষে দ্বিগুন বা তার বেশী হওয়ারও অনেক নজির আছে। একদিকে বিশেষ দেশের বিশেষ কোম্পানীকে কোন টেন্ডার ছাড়াই বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সড়ক মহাসড়কে যানচলাচল নিয়ন্ত্রনে আরো কঠোর আইন প্রণয়নের বদলে একটি বিশেষ শ্রেনী বা গোষ্ঠির স্বার্থে আইন পরিবর্তনের অপরিনামদর্শি সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়ক-মহাসড়ক ও সেতুগুলো অল্পদিনেই ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করতে নতুন আইনের প্রস্তাবনা আসলেও এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের স্বার্থের কাছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা জাতীয় স্বার্থের আপস করতে চলেছেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীসহ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের আপত্তি সত্বেও মালবাহী যানবহনের লোডিং ক্যাপাসিটি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
এমনিতেই সড়ক মহাসড়ক নির্মান ও মেরামতের ব্যয় বেড়ে চলেছে। গত ১লা নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় মহাসড়ক, সেতু ও কালর্ভাট মেরামতের জন্য ১৮৫৫.৫৮কোটি টাকার জরুরী বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। সড়ক মহাসড়কে অতিরিক্ত মালবোঝাই ট্রাক-কার্ভাড ভ্যান চলাচল নিয়ন্ত্রন করতে না পারায় নির্মান বা মেরামতের পর অল্পকিছুৃদিনের মধ্যেই তা নষ্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটি(বিবিএ) সাড়ে ১৫ টনের স্থলে গাড়ীর ওজন ২২ টনে উন্নীত করার খেসারত সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দিতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবী করেছেন। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুসহ নব নির্মিত সেতুগুলো এখন ২০-২৫ টন গাড়ীর ওজন বহনে সক্ষম হলেও দেশের সড়ক মহাসড়কে এমন অনেক সেতু রয়েছে যেগুলো তিন-চারদশক বা তারো বেশী পুরনো ও জরাজীর্ণ। অতিরিক্ত মালবোঝাই ট্রাক এসব সেতুর আয়ু স্বল্প সময়ে শেষ করে দিচ্ছে। আর্থিক সংকটের কারণে শত শত জরাজীর্ণ সেতু ও বেইলী ব্রীজ সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছেনা। অতিরিক্ত মালবোঝাই ট্রাকের কারণে প্রায়শ এসব সেতু ও বেইলী ব্রীজ ভেঙ্গে পড়ে ব্যাপক জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এসব বাস্তবতা সামনে রেখে সড়ক মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহনের ওজন নিয়ন্ত্রনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো ও জাতীয় সম্পদ রক্ষায় নতুন বিধিব্যবস্থা বাস্তবায়নের বদলে প্রভাবশালী পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগ অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত গ্রহন করলে তা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে। সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন