শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অবিলম্বে জ্বালানি তেলের মূল্য কমাতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়তে থাকলে, তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। লাগাম টেনে ধরা যায় না। জনগণের নাভিশ্বাস উঠে গেলেও তাতে সরকার বা সংশ্লিষ্টদের কিছু যায় আসে না। এমনকি উৎপাদন খরচ কমে গেলেও তার সাথে সমন্বয় করে কমানোর নজির নেই বললেই চলে। অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা তা কমাতে চায় না। সরকারও যে দাম কমানোর উদ্যোগ নিয়ে ভোক্তাদের জীবনযাপন একটু সহজ করে দেবে, তারও কোনো কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। অথচ সরকার ইচ্ছা করলে জিনিসপত্রের দাম কমানোর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জনবান্ধব হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে। এদিকে সরকারের দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে অনেকটা নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যেও ব্যবসায়ীদের মতো আচরণ পরিদৃষ্ট হয়। সরকারের আচরণ যদি এমন হয়, তাহলে জনগণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য যখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, তখনও দেখা যাচ্ছে, সরকার মূল্য কমাতে খুব একটা ইচ্ছা প্রকাশ করছে না। বিশেষজ্ঞরা তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কমানোর তাকিদ দিলেও সরকার গড়িমসি করছে। গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি তেলের দাম আরও এক দফা কমে ব্যারল প্রতি ২৭.৬৫ ডলারে নেমেছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইরানের উপর থেকে আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে যাওয়ায় এ দাম আরও কমতে পারে বলে খবরে বলা হয়েছে। ইরানের তেল বিশ্ববাজারে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তেলের দাম অদূর ভবিষ্যতে আর বাড়বে না বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম না কমানোর আর কোনো যুক্তি না থাকলেও সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে বাংলাদেশেও বিগত কয়েক বছরে একাধিকবার দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। তখন এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্তই বহাল থেকেছে। সরকারের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে করতে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সংস্থাটিকে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিতে হয়েছে। এভাবে লোকসান দিয়ে আর চলা যায় না। তাই দাম বাড়াতেই হবে। সরকারের এই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আপত্তি না থাকলেও যে হারে বাড়ানো হয় তা নিয়ে আপত্তি ছিল। সরকার তাদের এ আপত্তি গ্রাহ্য না করেই তেলের দাম বাড়ায়। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেশের অর্থনীতির ওপর পড়েছে। পরিবহন খরচ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এক লাফে অনেক গুণ বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতিও দেখা দেয়। এ অবস্থার মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারল প্রতি ১২০ ডলার থেকে নামতে নামতে ৩৫ ডলার এবং সর্বশেষ ২৭.৬৫ ডলারে নেমেছে। তেলের মূল্যের এই অবনমন শুরু হয় গত বছর থেকে। তখন থেকেই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসছেন, বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে তেলের দাম কমানো উচিত। সরকার তাতে কর্ণপাত না করে বর্ধিত মূল্য কমানোর উদ্যোগ নেয়নি। এই বর্ধিতমূল্য নিয়ে বিপিসি তার ভর্তুকির লোকসান ও ব্যাংক লোন পরিশোধ করে এখন একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে সংস্থাটি প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, দাম কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেল নির্ভর পরিবহনের মাধ্যমে যেসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে, তার খরচও কমে গেছে। এর মাধ্যমেও সরকার ব্যাপক লাভবান হচ্ছে। এমতাবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর জন্য অর্থনীতিবিদরা সরকারের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার এ নিয়ে তেমন কোনো রা করছে না। সরকার ব্যবসায়ীদের মতো অনেকটা তেল বাণিজ্য করে চলেছে। জনগণের উপর যে বোঝা চাপিয়েছে তা নামানোর পরিবর্তে অব্যাহত রেখেছে। এটা জনগণের উপর এক ধরনের নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ অর্থনীতিবিদরা বারবার বলে আসছেন, তেলের দাম কমালে এর ব্যাপক সুফল জনগণ পাবে। জিডিপি’র প্রায় এক শতাংশ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতিও হ্রাস পাবে। সরকার যেন এসবের কোনো কিছুই বিবেচনায় নিচ্ছে না। গতকাল প্রকাশিত একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ে আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে, জ্বালানি তেলের দাম কমানো যায় কিনা।’ অর্থমন্ত্রীর এ কথা থেকে বোঝা যায়, জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো নিয়ে সরকার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে। তেলের দাম কমানোর সুফল পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে। প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সরকার যেন আবার তেলের মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষায় রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম কমানো নিয়ে সরকারের এ ধরনের আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অগ্রহণযোগ্য।
জ্বালানি তেলের দাম কমালে মন্থরগতিতে চলা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এ সুযোগ সরকার কেন নিচ্ছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তাহলে কি সরকার চায়, জনগণ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হোক? জনগণের সুবিধার দিকটি বিবেচনা না করে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি পোষণ করা কি কোনো সরকারের কাজ হতে পারে? এ ধরনের মনোভাবকে তোঘলকি কা- ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে, তা আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, অবিলম্বে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে। জনগণের উপর মূল্যবৃদ্ধির যে বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তা নামিয়ে স্বস্তিকর জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন