চট্টগ্রাম ব্যুরো : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি বলেছেন, সরকার ইসলামী শিক্ষা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক, ছেলে-মেয়েদের নৈতিক শিক্ষাসহ মাদরাসা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় আধুনিক শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করে একশ’ বছরের দাবি ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ঢাকার গাউছুল আযম কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভায় আমি অনেকবার গিয়েছি। আলেম-ওলামাদের সাথে কথা বলেছি। তিনি উল্লেখ করেন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সহযোগিতা ও আলেম-ওলামা-মাশায়েখগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
গতকাল (শনিবার) নগরীর মুরাদপুরে একটি কনভেনশন হলে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা আয়োজিত ‘মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যাতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও আশা পূরণ হয়। পাঠ্যসূচি প্রণয়নে প্রকৃত আলেম তৈরির বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে, তারা যেন দেশ ও দেশের বাইরেও কাজে আসে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হতে পারে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মেধার দিক দিয়ে দরিদ্র নয়। তারা এখন অনেক অগ্রসর। সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে নিজেরা গড়ে উঠছে। শিক্ষা, খাদ্য ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক ত্রæটি আছে, অনেক ভুল আছে এবং অনেক ব্যর্থতাও আছে। এটি স্বীকার করছি। তবে দেশের মানুষ বলছে, শিক্ষাক্ষেত্রে বেশি উন্নতি হয়েছে। পুরো পৃথিবী আজ বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তনের কথা বলছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কিছু লোকের কারণে অনেকে আজ ইসলামকে ভিন্নভাবে রঙ মাখানোর চেষ্টা করছে। প্রকৃত আলেম ও ইসলামের অনুসারীরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) প্রদর্শিত পথে চলতে পারে, তাহলে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ও তার দলীয় প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করার অভিযোগ তুলে নাহিদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারই মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বড় বড় আলেমের পাশাপাশি ভাল অফিসারও বের হবেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নতমানের শিক্ষা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, এমপিওভুক্ত মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হয়েছে। তারা গত জুলাই থেকে পে-স্কেলে বেতন পাবেন। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টিসহ ৩১টি মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। আলাদা মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর করা হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। দেশের সব থানায় একটি করে কারিগরী শিক্ষা হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এমপিদের কাছ থেকে একটি করে স্কুল ও ছয়টি মাদরাসার তালিকা চাওয়া হয়েছে। শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে চট্টগ্রামে ৫৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। মাদরাসায় সকল লেভেলে সবার মর্যাদা সমান করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ১১৩০টি মাদরাসা ভবন নির্মিত হয়েছে। বিগত জোট সরকারের আমলে একটি মাদরাসা ভবনও হয়নি। নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসলে ইসলাম থাকবে না। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে ইসলামী শিক্ষার প্রসার ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে ব্যাপক কাজ হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ইউনেস্কো সম্মেলনে আমি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। সম্মেলনে বক্তারা বাংলাদেশকে শিক্ষাক্ষেত্রে অনুকরণীয় দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হবে। তখন আর দারিদ্র্য থাকবে না। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বাংলাদেশকে মধ্যআয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা শ্রীলংকায় ৫০ লাখ টন চাল রফতানি করেছি। নেপালে ১০ লাখ টন রিলিফ দিয়েছি। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীন ছিল না। ৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। মাতৃভাষার প্রতীক ২১ ফেব্রæয়ারী আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের। তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের প্রচার-প্রসারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সময়ে বাংলাদেশ ওআইসি’র সদস্যভুক্ত হয়েছে।
প্রফেসর আবদুল মান্নান
মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, আমরা সবাই মাদরাসা শিক্ষার মঙ্গল চাই। এখন আপনারা সবাই মিলে পাঠ্যসূচি ঠিক করুন। আপনারা কোরআন-হাদিস শিক্ষা দেবেন। আবার জীবনমুখী শিক্ষাও দেবেন। যাতে একজন ছাত্র মাদ্রাসা থেকে পাস করে অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে মাদরাসা শিক্ষা শুরু হয়। পবিত্র মক্কা নগরীতে সাফা-মারওয়া পাহাড়ে প্রথম শিক্ষা শুরু হয়। শিক্ষক ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। ১৪শ’ বছর পর এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। দেশের মাদরাসাগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে মাদরাসা শিক্ষার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ইসলাম আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখছে। তিনি বলেন, মাদরাসাগুলোর উন্নয়নে কারিকুলাম উন্নয়ন করতে হবে।
শাব্বীর আহমদ মোমতাজী
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী বলেন, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের ৩১টি মাদরাসায় অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। আল্লামা মোমতাজী বলেন, চট্টগ্রামের ওলামা-মাশায়েখরা আহলে সুন্নাতের অনুসারী। তিনি বলেন, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা শিক্ষকদের বৃহত্তর অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। এদেশের পীর-মাশায়েখ, আল্লাহর ওলিদের সহায়তায় আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিকতায় জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সারাদেশে মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে আনন্দ মিছিল করে মোবারকবাদ জানিয়েছেন। অধ্যক্ষ মোমতাজী বলেন, মওদুদী ও ওহাবীদের সাথে এদেশের ওলামা-মাশায়েখ ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের কোন সম্পর্ক নেই। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এদের বিরোধী। তাদের কোনমতে প্রতিষ্ঠা হতে দেয়া যায় না। তিনি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষার সমস্যার সমাধান, ফাজিল-কামিল মাদরাসার শিক্ষক জনবল কাঠামোর সমস্যার সমাধান এবং অনতিবিলম্বে নতুন বেতন স্কেলে বেসরকারী শিক্ষকদের বেতন প্রদানের দাবি জানান এবং মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
চবি ভিসি
অন্যতম বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চবি ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অসা¤প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গঠনে মাদরাসার শিক্ষার্থী ও আলেমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার দর্শন দিয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ঈষর্ণীয় উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সকলকে সম্পৃক্ত করেছেন। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছে।
মাদরাসা বোর্ড চেয়ারম্যান
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর এ কে এম ছায়েফ উল্যা বলেন, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। ইউনেস্কোর ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি ১৯৬২’র শিক্ষানীতি আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন। তার হাতেই বর্তমানে শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে মাদরাসা শিক্ষা অবহেলিত হয়নি। মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা হয়েছে। ৫ হাজার ৫শ’টি মাদরাসায় ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। আগামী ২৩ মার্চ ডিজিটাল মাদরাসা উদ্বোধন করা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালের মধ্যে একটি মাদরাসাও সৃজনশীলের বাইরে থাকবে না। ইসলামী আরবি শিক্ষার উন্নয়নে সউদি আরব ৩৬ ডলার সহায়তা দেবে।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর সভাপতিত্বে উক্ত সভায় আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জমিয়াত নেতা অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল বয়ান হাশেমী, অধ্যক্ষ মাওলানা মোক্তার আহমদ, অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল ফরাহ মোঃ ফরিদ উদ্দিন, মাওলানা ইসমাইল নোমানী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ আলেম-ওলামা-মাশায়েখ বিশেষত চট্টগ্রাম বিভাগের ৩১৬টি ফাজিল ও কামিল মাদরাসার আমন্ত্রিত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষিকারা অংশগ্রহণ করেন। বিকেলে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয় অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন