আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সেনা মোতায়েনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গত সোমবার এ কথা জানান তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সব দলের অংশগ্রহণ ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। প্রথমত: নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার পাশাপাশি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার এবং সেনা মোতায়েনের প্রস্তাবেও পরস্পর বিরোধি অবস্থানকে এক ধরনের ডেডলক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। গত ১২ নভেম্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং ইভিএম ও মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের দাবী জানানোর পর দুই প্রধান রাজনৈতিক পক্ষের পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান আবারো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তা করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। বিএনপি বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের দাবীর কারণে নয়, নির্বাচনে সফলভাবে ইভিএম ব্যবহারের বাস্তবতা ও সক্ষমতা এখন নির্বাচন কমিশনের নেই এবং নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত রাখতেই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার থেকে বিরত থাকছে বলে কমিশনার জানিয়েছেন। অন্যদিকে সেনা মোতায়েনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থাকলেও সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হবে নাকি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে থাকবে সে বিষয়ে এখনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার কোন বিকল্প নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো বিএনপি’র সাথে আলোচনায় না বসার অনড় অবস্থান দেখা যাচ্ছে, তথাপি এটা প্রত্যাশা করা অস্বাভাবিক নয় যে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতে আসতে দুই পক্ষের দূরত্বের বরফও হয়তো গলতে শুরু করবে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বিশিষ্টজনেরাও দুই দলের মধ্যে সংলাপকেই সংকট সমাধানের একমাত্র পন্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর নির্বাচনকালীন সরকার বা এ ধরনের সংকটের স্থায়ী সমাধানের প্রশ্নে দেশের রাজনীতি তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন বিশিষ্টজনেরা। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন না হলে দেশে স্থায়ী ও ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বেশীরভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এবং বেশীরভাগ আসনে বিনাভোটে সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ ধরনের নির্বাচন একদিকে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে অন্যদিকে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অচলাবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার কার্যকর পন্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরুতেই রাজনৈতিক বিতর্ক ও মতভেদ থাকলেও নির্বাচন কমিশনকে তাদের সিদ্ধান্ত, কর্মকান্ড এবং দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করতে হবে তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও ইভিএম ব্যবহার প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কমিশনের যে প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তা সবদিক থেকেই ইতিবাচক ও সময়োপযোগী বক্তব্য। প্রথমত: আমাদের জাতীয় নির্বাচনে কখনো ইভিএম ব্যবহৃত হয়নি বা পরীক্ষিত নয়। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও ইভিএম নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও অস্বচ্ছতা রয়েছে সেখানে আমাদের মত অনগ্রসর ও রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত সমাজে কোন সমাঝোতা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। দ্বিতীয়ত: আমাদের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে আশানুরূপ ভ’মিকা রাখতে পারেনি সেনাবাহিনী সেখানে সর্বদাই সফল। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি বিশ্বের বহু যুদ্ধবিদ্ধস্ত ও বিবদমান দেশেও আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষি মিশনের সদস্য হিসেবে নির্বাচন পরিচালনায় সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নির্বাচনকালীন সরকার যেমনই হোক নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মেজিস্ট্রেসি পাওয়ারসহ নিরপেক্ষ ভ’মিকা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আস্থা এনে দিতে পারে। দেশের সর্বত্র হাজার হাজার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি, এমনকি স্থানীয় নির্বাচনেও অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের কদর বেড়ে যেতে দেখা গেছে। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে থোরাই কেয়ার করে। সেখানে জাতীয় নির্বাচনে এদের নিয়ন্ত্রনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছা ও সাফল্য নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনামোতায়েনই হতে পারে একমাত্র বিকল্প। একটি সুষ্ঠু গণতান্তিক পরিবেশ ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন নির্বাচনের আগে-পরের দু’চারদিনের কর্মকান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সব রাজনৈতিক পক্ষের সমঝোতা, সদিচ্ছা, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় ছাড়া একটি সুষ্ঠু অবাধ ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন