প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও বিদেশী ফান্ড ব্যবহারে অক্ষমতার প্রেক্ষাপটে সরকার চলতি বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপির) জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্য থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তকর্তারা পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ব্যয়বরাদ্দ ৯০ হাজার কোটি টাকায় এসে দাঁড়াতে পারে। তারা আরো জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ইতোমধ্যেই বিদেশী ফান্ড থেকে ৫২২০ কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এডিপিতে বরাদ্দকৃত বিদেশী ফান্ডের অর্থ কমাতে বলেছে। চলতি এডিপিতে বিদেশী উৎস থেকে ৩৪৫ বিলিয়ন টাকা পাওয়া যাবে বলে দেখানো হয়েছে। এটা যে কোনো বিবেচনায় দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে শ্লথতা ও বিদেশী উৎস থেকে প্রাপ্তব্য অর্থ ব্যবহারের অপারগতার জন্য সরকারকে এডিপি থেকে বড় অংকের অর্থ কর্তন করার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এই ব্যর্থতার দায় কে বহন করবে? সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে বহুবার এডিপি বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যথাসময়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপির আওতাধীন প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, এই তাকিদ ও নির্দেশনা কোনো কাজে আসছে না। প্রতি বছরই এডিপির বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে, অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। এবারের অবস্থা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় শোচনীয়। জানা গেছে, চলতি বছরের এডিপিতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় গত ছয় বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন। প্রথম সাত মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলেও একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ২৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের নিম্নগতি বা নিম্নহারের কারণেই অন্যান্যবারের মতো এবারও বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হচ্ছে।
দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ ইত্যাদি ধরনের মুখরোচক বাণী অহরহ বর্ষিত হচ্ছে সরকারি মহল থেকে। কিন্তু উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র যে এর ব্যতিক্রম এডিপি বাস্তবায়নের হাল থেকেই তা অনুধাবন করা যায়। প্রতি বছরই বড় বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, অথচ তার বাস্তবায়ন যথাসময়ে যথাযথভাবে হচ্ছে না। বিদেশী উৎসের অর্থও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্থরতা, গড়িমসি একটি নিয়মিত ও সাধারণ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। বহুবার এ কথা বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো না গেলে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। দুঃখের বিষয়, বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও এই দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হচ্ছে না। অক্ষমতা, অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হলে নতুন করে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পূর্ব বরাদ্দের চেয়ে বেশী হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমাও ঠিক থাকছে না, বরাদ্দও ঠিক থাকছে না। এতে দেশকে প্রকল্পের সুবিধা প্রাপ্তি থেকে যেমন বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে তেমনি বেশী ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা ও বিদেশী ঋণের টাকার অপচয় হচ্ছে। এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বলাবাহুল্য, প্রকল্প গ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দই বড় কথা নয়, তার যথাসময়ে সুচারুরূপে বাস্তবায়নই বড় কথা। এটা হলেই কেবল প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া সম্ভব। আমরা প্রতিবছরই লক্ষ্য করছি, বাজেটে উন্নয়ন খাতে বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। আবার মাঝ পথে সেই বরাদ্দ কাটছাঁট করা হচ্ছে। এটা একটা কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অবসান একান্তভাবেই কাম্য।
ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, অর্থ বছরের প্রথম দিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের খবর থাকে না, অথচ শেষদিকে রীতিমত ধুম পড়ে যায়। শেষ তিন মাসে অর্থ ব্যয়ের জোয়ার সৃষ্টি হয়। টাকা খরচ করাটাই তখন বড় হয়ে ওঠে। কোথায় খরচ হচ্ছে, কিভাবে খরচ হচ্ছেÑ এসব দেখা হয় না। এই দ্রুত অর্থ ব্যয়ের প্রবণতার সঙ্গে দুর্নীতি ও লুটপাটের নিকট সম্পর্ক রয়েছে বলে বরাবরই প্রতীয়মান হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান যোগসাজশ করে অর্থ লুটপাট করে থাকে, এ অভিযোগ পুরনো। সবচেয়ে বড় কথা, শেষ দিকের এই তোড়জোড় ও লুটপাটের কারণে কাজের মানও ভালো হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়নের এই ধারা ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনার বিকল্প নেই যদি আমরা উন্নয়নলক্ষ্য অর্জন করতে চাই। ধীরগতি, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকল্পের অগ্রগতি ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অক্ষমতা রয়েছে তা দূর করতে হবে। সততা, দায়িত্বশীলতা ও বাস্তবায়নসক্ষমতা ঘাটতি রেখে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন আশা করা যায় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন