জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়োগের বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা ‘সরকারী কর্মচারী আইন’র খসড়া চুড়ান্তকরণের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবেচনা আরো পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাংবিধানিক এখতিয়ারকে কাজে লাগাতে চায় সরকার। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনে ভয়াবহ সংকট ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। জনপ্রশাসন রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র। ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা ব্যুরোক্রেসি একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আজকের অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নিয়মনিষ্ঠা ও জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে পদায়ণ ও পদোন্নতি হয়ে থাকে। এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রশাসনে অসন্তোষ, ক্ষোভ, স্থবিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সরকারগুলো নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অগ্রাহ্য করে, দলীয় বিবেচনায় জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ন পদে কিছু কর্মকর্তার পদন্নোতি ও পদায়ণ করার কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি নজির রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় সচিবালয় থেকে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত এর দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সর্বত্রই এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমনিতেই দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর যথাসময়ে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা(এডিপি) বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে অসন্তোষ ও নির্দেশনা প্রকাশের পরও গত এক দশকে অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদ শেষে প্রশাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় বিবেচনায় রদবল হওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার খবর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে এক সময় অবস্থা সামাল দেয়া সম্ভব হলেও জনপ্রশাসনের শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও মেধাবী কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার প্রয়াস সার্বিকভাবে নেতিবাচক ফল দেয়।
জনপ্রশাসনের মত স্পর্শকাতর ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে দলীয় বিবেচনায় বাইরের লোকদের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে নিয়োগ দেয়ার বিধান অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। সিভিল ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তি ও রক্ষাকবচ। সরকারে যারাই থাকুক, যে পন্থা বা পদ্ধতিতেই দেশ পরিচালিত হোক, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়মতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা ও আভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। দীর্ঘদিনে চলে আসা এই শৃঙ্খলা ও নিয়মনিষ্ঠা এক ধরনের সেল্ফ সেন্সরশিপ বা দায়িত্বশীলতার সংস্কৃতি তৈরী করেছে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদায়ণ করতে গিয়ে গত কয়েক বছরে এমনিতেই প্রশাসনে নানা ধরনের সমস্যা তৈরী হয়েছে। নতুন আইনের আওতায় দলীয় বিবেচনায় বাইরে থেকে প্রশাসনের উচ্চপদে লোক নিয়োগ কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়। প্রশাসনে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এর মধ্য দিয়ে জনপ্রশাসনের বিদ্যমান শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। দলীয় বিবেচনা ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনীতে জনবল নিয়োগের কারনে বিভিন্ন স্থানে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ার আলামত ইতোমধ্যে ে দখা দিয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোনয়ন ও আর্শিবাদপুষ্ট এ ধরনের কর্মকর্তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা না করেই বেপরোয়া কর্মকান্ড চালিয়ে পুরো বাহিনীর ভাব মর্যাদা ক্ষুন্ন করছে। অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হতাশ ও হতদ্যোম হয়ে পড়ায় প্রশাসনে এক প্রকার স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রশাসনের ভেতরে চাপা অসন্তোষ ও হতাশা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও নিয়মনিষ্ঠাকে পুঁজি করে যেখানে বহুবছর ধরে লালিত স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পদন্নোতির জন্য অপেক্ষা করেন, সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের ফলে তাদের বঞ্চনার শিকার হতে হয়। এ ধরনের বঞ্চনা প্রশাসনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও গতিশীলতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখেন। জনপ্রশাসনের চাকুরী বিধি ও নিয়মশৃঙ্খলা এ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ার হয়তো রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি প্রয়োজনীয় অধ্যায়। রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারকে সাধারণ আইনে পরিণত করার প্রক্রিয়া কতটা সঙ্গত তা বিবেচনার দাবী রাখে। বলা বাহুল্য, দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়োগকে আইনসিদ্ধ করার হঠকারি সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে, দলীয় রাজনৈতিক পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে থেকে রাষ্ট্র ও জনকল্যাণের জন্য কাজ করা। তাদের এই নিরপেক্ষতা রক্ষায় সরকারী চাকুরী বিধি গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে থাকে। এমতাবস্থায় যে কোন মূল্যে প্রশাসনকে তার নিজস্ব ধারাক্রমে ও নিয়মের মধ্যে রাখা বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে দিতে পারে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে রেখে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলার মধ্যে সচল ও জবাবদিহিতার আওতায় রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন