বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শান্তি প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের কুঠারাঘাত

| প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশ্ব সম্প্রদায়ের সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করে অবেশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভ’-খন্ডের উপর ইসরাইলের কর্তৃত্ব জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পায়নি। প্রায় অর্ধশত বছর ধরে অব্যাহত ফিলিস্তিনী শান্তি প্রক্রিয়া ও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের মূল ইস্যুই হচ্ছে পূর্ব জেরুজালেমের অবস্থান। একাধিক জাতিসংঘ রেজুলেশনসহ প্রায় সবগুলো শান্তি উদ্যোগেই জেরুজালেমের ভাগ্য নির্ধারনে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সমঝোতার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই দশক পর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জেরুজালেম দখলের পর থেকেই ইসরাইল জেরুজালেমকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করলেও এ দাবীর কোন যৌক্তিক বা ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এক প্রস্তাবনায় জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের দাবীকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছে। ফিলিস্তিনের উপর দখলদারিত্ব, অবরোধ ও অমানবিক আগ্রাসনের কারণে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের আরব প্রতিবেশী এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গত দুই দশকের বেশী সময় ধরে চলা আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সে প্রচেষ্টায় কুঠারাঘাত করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্য একটি দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অনিশ্চয়তা থেকে বেরোতে পারছেনা। এ কারণেই আরব মিত্রদের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররাও তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের সম্ভাব্য উদ্যোগ সম্পর্কে সকলেই সতর্ক বিরোধিতা প্রকাশ করেছিল। মূলত: ১৯৯৫ সালের একটি আইনের আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ ক্ষমতার উপর ছেড়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা এবং ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এবং জাতিসংঘের রেজুলেশন ২৪২ এবং ৩৩৯ এর আলোকে গত দুই দশকের বেশী সময়ে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ঝুঁকি গ্রহণ করেননি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত যে শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার লিগ্যাসি নস্যাৎসহ পুরো অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা ও সংঘাতের জন্ম দেবে তা ছিল অবধারিত। ট্রাম্পের ঘোষনা প্রকাশিত হওয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে সংশ্লিষ্ট সকলের আশঙ্কাই প্রমানিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ এবং হামাস-হেজবুল্লাহর মত ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। সউদি আরব এবং ইরাণসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবদেশই মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। সউদি বাদশাহ সালমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনার আহŸান জানিয়েছেন। সেই সাথে জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, ফরাসী প্রেসিডেন্ট, জার্মান চ্যান্সেলর এবং রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকেও এই সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা হয়েছে। আরবলীগ এবং ওআইসির মত সংস্থার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে এবং এসব সংস্থা শীঘ্রই সম্মেলন ডেকে তাদের পরবর্তি পদক্ষেপ গ্রহন করবে বলে জানা গেছে। ট্রাম্পের ঘোষনা প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মার্কিন বিরোধি বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মার্কিন পতাকা এবং ট্রাম্পের ছবি ও কুশপুত্তুলিকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বেথেলহেমে খ্রিষ্টানদের ক্রিসমাস ট্রির আলোকসজ্জার বিদ্যুত সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে বিক্ষোভকারিরা। মধ্যপােচ্যর অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র এবং ওআইসি’র নেতা হিসেবে তুরস্ক ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে মার্কিনস কনস্যুলেটের সামনে শত শত মানুষ বিক্ষোভ করছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।
মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃত জেরুজালেম নগরীকে একই সঙ্গে মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদিদের পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনের উপর মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং সব ধর্মের মানুষ সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিল। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সব সময়ই ফিলিস্তিনী জনগনের সাথে সংহতি জানিয়ে আসছে। জেরুজালেমের অবমুক্তি ও মর্যাদা পুন:প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সর্বদা অঙ্গিকারাবদ্ধ। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি এবং মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের মানুষের হতাশা ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুললেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে। সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এমনিতেই অত্যন্ত নাজুক। সিরিয়ায় ইসরাইলী বিমান হামলা এবং লেবাননের উপর আগ্রাসনের অব্যাহত হুমকি যে কোন সময় আরেকটি রক্তাক্ত আরব-ইসরাইল সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই ট্রাম্পের ঘোষনা ইচ্ছাকৃতভাবে সব শান্তিপ্রক্রিয়ার ইতি এবং সংঘাত উস্কে দেয়ার প্রয়াস হিসেবে গণ্য করছেন অনেকে। এহেন পরিস্থিতিতে সংঘাত ও রক্তপাত এড়াতে জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়কে ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আল আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সসহ পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন